বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে অনেক সিনেমাই নির্মাণ হয়েছে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে। যার প্রতিটি সিনেমায় তুলে ধরা হয়েছে সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন বিষয় যা একদিকে সংবেদনশীলতার নামে ছিল উপেক্ষিত, অন্যদিকে সমাজ কাঠামোর নিরাপদ ছায়াতলে ছিল বেশ শক্তিশালী। যেসব সিনেমায় তুলে ধরা হয়েছে ধর্মীয় কুসংস্কার ও সংকট। লিখেছেন -ফয়সাল আহমেদ
যে কয়জন চলচ্চিত্রকার সিনেমাকে শুধু বিনোদনের মাধ্যম না ভেবে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তাদের মাঝে তারেক মাসুদ অন্যতম। তিনি ধর্মীয় কুসংস্কারকে উপজীব্য করে ২০০২ সালে নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র ‘মাটির ময়না’। সম্পূর্ণ গ্রামীণ পরিবেশে ১৯৭১ সালের প্রেক্ষাপটে তৈরি এ চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রের একজন গ্রামের মধ্যবয়সী শিক্ষিত কিন্তু গোঁড়া ও রক্ষণশীল ব্যক্তি কাজী সাহেব। হিন্দুয়ানি সকল আচার পরিত্যাগে তিনি বদ্ধপরিকর। তার পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে আছেন তার স্ত্রী, দুই সন্তান আনু ও আসমা এবং ভাই মিলন। নিজ ইচ্ছায় ছেলেকে ভর্তিও করিয়েছেন মাদ্রাসায়। কিন্তু পরিবারের অন্যরা কেউই কাজী সাহেবের মতো নন। আহমদ ছফার ভাষায় ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ বলতে যা বোঝায় তার সবটাই আছে তাদের মাঝে। মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী ও নুসরাত ইমরোজ তিশা অভিনীত আলোচিত ‘টেলিভিশন’ সিনেমাটি বাংলাদেশে ২০১৩ সালের ২৫ জানুয়ারি মুক্তি পায়। ছবি তোলা বা টেলিভিশন দেখা ঠিক না এক প্রত্যন্ত গ্রামের চেয়ারম্যান এক বয়স্ক মুরুব্বির এই মূল্যবোধের সঙ্গে এ কালের অবারিত মিডিয়ার এই দুই এর সংঘাতকে অনুষঙ্গ করে আবর্তিত হতে চেয়েছে সিনেমার কাহিনী। তবে ধর্মীয় সংকট নিয়ে প্রেমনির্ভর সিনেমা বেশি নির্মিত হতে থাকে নব্বই দশকের পর থেকে। একে একে যুক্ত হয় ‘অবুঝ দুটি মন’, ‘দোলা’, ‘প্রেম পিয়াসী’, ‘আজ গায়ে হলুদ’, ‘প্রেমের তাজমহল’, ‘সবার উপরে প্রেম’, ‘ছোট্ট একটু ভালোবাসা’, ‘জীবনের চেয়ে দামী’, ‘ভুল’, ‘এই তো প্রেম’, ‘অন্তরজ্বালা’, ‘স্বপ্নজাল’ থেকে সর্বশেষ ‘ফাগুন হাওয়ায়’। সিনেমাগুলো মূলত প্রেমে ধর্মীয় সংকট দর্শকদের জানাতে নির্মাতারা বানিয়েছেন।
বলিউডে তো ধর্ম এসেছে নানা উদ্দেশ্য ও রাজনীতি নিয়ে। ধর্মের এপিঠ ওপিঠ দেখানো হয়েছে হিন্দি সিনেমায়। বলিউডে এসব সিনেমা হয়েছে আলোচিত, পড়েছে বাধার মুখে। বিপরীতে পেয়েছে সফলতাও। ভাবিয়েছে হয়তো দর্শকদের। নানা ছবিতে এসেছে ধর্ম। দেখা যাক, কোন ছবিতে ধর্মকে কিভাবে দেখানো হয়েছে। ভারতের মালায়ালামে ‘সন অব আদম’ নামে সুন্দর একটি সিনেমা আছে। ২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমায় এক দম্পতির হজে যাওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নপূরণের গল্প বলেছে। এ ধরায় সবচেয়ে আলোচিত সিনেমা ‘পিকে’। ছবিতে পিকে নামক এক ভিনগ্রহবাসী মানুষের সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মের মোল্লা, পুরোহিতদের সংঘাতকে দেখানো হয়েছে। যেখানে যুক্তিবাদী পিকের জয় হয়। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সৃষ্ট রং নাম্বার পিকে উন্মোচিত করলে, একটি প্রেমকে আমরা পুনরুদ্ধার হতে দেখি। পিকে ধর্ম নয় ধর্মের নামে ফন্দি-ফিকিরের বিরুদ্ধে তৈরি হয়েছে। হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্ম নিয়ে মানুষের ব্যবসা, তা নিয়ে সিনেমা। এ ধারার আরেকটি সিনেমা ‘ওহ মাই গড’। ‘মাই নেম ইজ খান’ সিনেমায় শাহরুখ খান রেজওয়ান খানের চরিত্রে অভিনয় করেন; যিনি মুসলমান ও আমেরিকায় বাস করেন। প্রেমের সিনেমা হলেও দিয়েছে কিছু মেসেজও। সিনেমাটি ৯/১১ হামলার পরের প্রেক্ষাপট নিয়ে নির্মিত হয়েছে। যেখানে নিরীহ মুসলমানরাও কিভাবে সেখানে বসবাস করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। ‘আর্থ’ দেশ ভাগের সময়কার চিত্র এই গল্পে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দীপা মেহতার পরিচালনায় ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে বন্ধু হয়েও একটা সময় কিভাবে হিন্দু-মুসলমান আলাদা হয়ে যায়। পরিবেশ তাদের শত্রু করে দেয়। ধর্ম কিভাবে মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় হয়ে ওঠে, যেখানে বন্ধুর রক্ত তুচ্ছ। এই ছবিতে সেই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কলকাতায় রাজ চক্রবর্তী নির্মাণ করেছেন ‘ধর্মযুদ্ধ’ নামে একটি সিনেমা। জাত-পাতের বিচারে ভেদাভেদের রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা অজান্তেই মানুষের যাপনের সঙ্গী হয়ে গেছে। বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ধর্মান্ধতার শিকার মানুষ। প্রেম-ভালোবাসা সবটাই বিচার্য ধর্মের নিরীখে। এর অন্যথা হলে একে অপরের রক্তের পিপাসু হতেও সময় লাগছে কই! এমনই টুকরো বাস্তবের ছবিকে চিত্রনাট্যের রূপ দিয়েছেন পরিচালক রাজ চক্রবর্তী। এ সময়ে নির্মিত ধর্ম নিয়ে বেশ ভালো একটি সিনেমা।