রবিবার, ০২:৫৩ অপরাহ্ন, ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১৯শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর দৃষ্টিতে সুন্নাহর প্রামাণিকতা

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক:
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
  • ৬ বার পঠিত

পবিত্র কোরআনের পর নবীজি (সা.)-এর সুন্নাহ হচ্ছে ইসলামের দ্বিতীয় প্রামাণিক উৎস। তবে এই দ্বিতীয় অবস্থান শুধু এর মর্যাদা, প্রামাণিকতা ও অকাট্যতার বিচারে, কিন্তু ব্যবহার ও কার্যকারিতার দিক থেকে সুন্নাহ প্রকৃতপক্ষে ইসলামী বিধানের প্রথম উৎস। কারণ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যেকোনো কথা বা কাজ, তা যেকোনো অবস্থায় প্রকাশিত হোক না কেন, রাগ বা খুশির সময়, কোমলতা বা কঠোরতার সঙ্গে, ব্যক্তিগত জীবনে অথবা উন্মুক্ত পরিবেশে, অমুসলিমদের সঙ্গে চুক্তিপূর্ণ সম্পর্কের সময় কিংবা শত্রুদের সঙ্গে জিহাদের ময়দানে, এমনকি ঘুমের মধ্যে দেখা স্বপ্ন—সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ওহির অন্তর্ভুক্ত।

এমন বহু বিধান রয়েছে, যা কোরআনের আয়াত নাজিল হওয়ার আগেই কার্যকর ছিল এবং দীর্ঘ সময় ধরে তা পালিত হয়েছে।

পরে কোরআনের কোনো আয়াতে সেসব বিধানের সমর্থনের ঘোষণা এসেছে। যেমন—অজুর বিধান সুরা মায়িদায় এসেছে, যা নাজিলের দিক থেকে কোরআনের সর্বশেষ সুরাগুলোর একটি। কিন্তু নামাজ ফরজ হওয়ার শুরু থেকেই অজুর পদ্ধতি সুন্নাহ অনুসারে প্রচলিত ছিল। এটি সুন্নাহর প্রথম উৎস হিসেবে অবস্থানের একটি দৃষ্টান্ত। (মাআরিফুস সুনান : ১/২৫১)

সুন্নাহ যেভাবে ইসলামের স্বাধীন উৎস

সুন্নাহ যেমন কার্যকারিতার দিক থেকে প্রথম উৎস, তেমনি ইসলামী বিধান ও শিক্ষার ক্ষেত্রে এটি স্বাধীন উৎসধারার মর্যাদাও রাখে। বহু ইসলামী শিক্ষা ও বিধান এমন রয়েছে, যা কোরআনের কোথাও সরাসরি উল্লেখ নেই। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) সুন্নাহকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন—

১. এমন সুন্নাহ, যা আল্লাহ তাআলা কোরআনে নাজিল করেছেন, আর রাসুলুল্লাহ (সা.) কথা ও কাজের মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা করেছেন।

২. এমন বিষয়, যা আল্লাহ তাআলা কোরআনে সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন, আর রাসুলুল্লাহ (সা.) তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।

৩. এমন সুন্নাহ, যার কোনো উল্লেখ কোরআনে নেই, বরং তা শুধু রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর থেকেই প্রাপ্ত। (আর-রিসালাহ, পৃষ্ঠা-৮০)

উল্লেখ্য, সুন্নাহ অনুসরণের দ্বারা সুন্নাহকে কোরআনের ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া আবশ্যক হয় না; বরং এটি আল্লাহর সেই নির্দেশনার অনুসরণ, যেখানে তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্য করতে জোর আদেশ দিয়েছেন। যদি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্য শুধু কোরআনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয়গুলোতেই সীমাবদ্ধ থাকত এবং অতিরিক্ত বিধানে তা প্রযোজ্য না হতো, তাহলে তাঁর অনুসরণ ও তাঁকে মান্য করার কোনো বিশেষত্বই থাকত না। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি রাসুলের আনুগত্য করল, সে নিশ্চয়ই আল্লাহর আনুগত্য করল।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৮০)

ইবনে কায়্যিম (রহ.) বহু এমন বিষয় উল্লেখ করেছেন, যেগুলোর কোনো উল্লেখ কোরআনে নেই, অথচ সেগুলো হাদিসের ভিত্তিতে কার্যকর।

যেমন—দুগ্ধপানের মাধ্যমে হারাম সম্পর্ক প্রমাণিত হওয়া, কোনো নারীর সঙ্গে তার খালা বা ফুফুকে একত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ হওয়া, শর্ত সাপেক্ষে বিক্রির অনুমতি এবং জমিসংক্রান্ত শুফার অধিকার ইত্যাদি।
(ইলামুল মুআক্কিঈন : ২/২২১) এ ধরনের বিধান কোরআনে কারিমে উল্লেখ না থাকলেও হাদিসের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।

এ ছাড়া সুন্নাহর আলোকে শরিয়তের বিধি-বিধান নির্ধারণ করা এবং তা থেকে নতুন মাসআলা উদ্ভাবন করা হয়। ফুকাহায়ে কেরামের কার্যপদ্ধতি এ বিষয়ে সুস্পষ্ট প্রমাণবাহী। সাহাবায়ে কেরামের শেষ যুগে এমন কিছু ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছিল, যারা মনে করত, শরিয়তের উৎস শুধু পবিত্র কোরআন। তারা অজ্ঞতাবশত সুন্নাহকে স্বাধীন উৎস হিসেবে মানতে দ্বিধা করত। হাদিসের কিতাবাদিতে এ ধরনের লোকদের সঙ্গে সাহাবায়ে কেরামের কথোপকথন ও প্রশ্নোত্তর বর্ণিত হয়েছে। এতে সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত প্রজ্ঞাপূর্ণ যুক্তিতর্কের মাধ্যমে তাদের জবাব দিয়েছেন।

ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.)-এর কথোপকথন

সাহাবি ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.)-কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, আপনারা (সাহাবায়ে কেরাম) এমন অনেক হাদিস বর্ণনা করেন, যেগুলোর উৎস আমরা কোরআনে পাই না। ইমরান (রা.) তাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি কোরআন পড়েছ? সে বলল, হ্যাঁ। তখন তিনি বলেন, তুমি কি কোরআনে পেয়েছ মাগরিবের নামাজ তিন রাকাত, এশার নামাজ চার রাকাত, ফজরের নামাজ দুই রাকাত আর জোহর ও আসরের নামাজ চার রাকাত? সে বলল, না। তিনি বলেন, তাহলে তুমি এগুলো কোত্থেকে পেয়েছ? আমরা কি তোমাকে এগুলো শেখাইনি? আর আমরা তো এগুলো রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ থেকেই পেয়েছি। তেমনি তুমি কি কোরআনে পেয়েছ, ৪০ ভাগের ১ ভাগ জাকাত ফরজ? অথবা নির্দিষ্টসংখ্যক ছাগল, গরু বা উটের ওপর নির্দিষ্ট জাকাত প্রযোজ্য? সে বলল, না। তখন তিনি বলেন, তাহলে তুমি এগুলো কোত্থেকে পেয়েছ? আমরা কি তোমাকে এগুলো শেখাইনি? আমরা তো এগুলো রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ থেকেই পেয়েছি। ইমরান (রা.) আরো বললেন, তুমি কি কোরআনে পেয়েছ যে কাবাঘরের তাওয়াফ সাতবার করতে হবে এবং তাওয়াফ শেষে মাকামে ইবরাহিমে নামাজ পড়তে হবে? সে উত্তর দিল, না। ইমরান (রা.) বলেন, তাহলে তুমি এগুলো কোত্থেকে পেয়েছ? আমরা কি তোমাকে শেখাইনি? আমরা তো এগুলো রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকেই শিখেছি। (আল-মুজামুল কাবির, হাদিস : ৫৪৭, মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদিস : ৩৭২)

জনৈকা নারীর প্রশ্নে ইবনে মাসউদ (রা.)-এর উত্তর

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহ তাআলা অভিশাপ দেন সেইসব নারীকে, যারা উলকি আঁকে এবং আঁকায়, যারা ভ্রু চেঁছে ফেলে, যারা সৌন্দর্যের জন্য দাঁতে ফাঁকা তৈরি করে এবং যারা আল্লাহর সৃষ্টি পরিবর্তন করে। একজন নারী এ কথা শুনে ইবনে মাসউদ (রা.)-এর ওপর আপত্তি তুলে বললেন, আমি পুরো কোরআন পড়েছি, কিন্তু আপনার এই কথার সমর্থন পাইনি। তখন তিনি বললেন, যদি তুমি ভালোভাবে পড়তে, তাহলে অবশ্যই তা পেতে। তুমি কি এই আয়াত পড়োনি—‘তোমাদের রাসুল যা আদেশ করেছেন তা গ্রহণ করো এবং যা থেকে তিনি বারণ করেছেন তা থেকে বিরত থাকো।’ (সুরা : হাশর : আয়াত ৭)

ওই নারী বললেন, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এসব কাজ থেকে নিষেধ করেছেন। (বুখারি, হাদিস : ৪৮৮৬)

এ কথার মাধ্যমে ইবনে মাসউদ (রা.) প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে রাসুলের হাদিস ও সুন্নাহ শরিয়তের একটি স্বাধীন উৎস। এ উদ্দেশ্যে তিনি ওই আয়াতকে দলিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)-এর কথোপকথন

জনৈক ব্যক্তি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)-কে জিজ্ঞেস করল, আমরা কোরআনে মুকিম অবস্থার নামাজ এবং যুদ্ধের অবস্থার নামাজের আলোচনা পাই, কিন্তু সফরের নামাজের কোনো উল্লেখ পাই না। ইবনে উমর (রা.) বললেন, ভাতিজা! আল্লাহ আমাদের কাছে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নবী হিসেবে পাঠিয়েছেন, আমরা কিছুই জানতাম না, আমরা যা করি, তা শুধু সেই কাজ, যা আমরা মুহাম্মদ (সা.)-কে করতে দেখেছি। (আস-সুনানুল কুবরা, নাসায়ি, হাদিস : ১৪৩৪)

ইবনে উমর (রা.)-এর এই সহজ উত্তরের মধ্যে এত গভীর তাৎপর্য লুকিয়ে আছে যে একজন রাসুলপ্রেমী মুমিনের জন্য হাদিস অনুসরণের এবং সুন্নাহকে শরিয়তের একটি স্বাধীন উৎস হিসেবে মানার জন্য এ কথাই যথেষ্ট।

খুলাফায়ে রাশেদিনসহ অন্য সাহাবারাও একই পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। যখন কোনো সমস্যার সমাধান কোরআনে কারিমে সুস্পষ্ট পাওয়া যেত না, তখন তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে সুন্নাহর দিকে মনোযোগ দিতেন এবং একে অপরের কাছে সেই সমস্যা সম্পর্কিত নবী (সা.)-এর নির্দেশনা জানার চেষ্টা করতেন। তাঁদের এই আচরণই সুন্নাহর স্বতন্ত্র ও স্বাধীন উৎস হওয়ার একটি মজবুত প্রমাণ।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com