রাজধানীর অলিগলি ও মূল সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রায় ১২ লাখ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইক। হাইকোর্টের তিন দফা নির্দেশনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিষেধাজ্ঞার পরও এগুলো বন্ধ হচ্ছে না। স্থানীয় কতিপয় নেতা এবং কিছু অসাধু পুলিশ ও চাঁদাবাজচক্রের যোগসাজশে এগুলো চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশেই চলছে এ ধরনের রিকশা। পুলিশের হিসাবে ঢাকাসহ সারা দেশে ৬০ লাখের বেশি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আছে। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখা যায়, এসব রিকশার ব্যাটারি চার্জে দিনে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যয় হচ্ছে। যার অধিকাংশই মূল লাইন থেকে অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে নেওয়া হচ্ছে। ফলে এর অর্থ সরকার পাচ্ছে না। বর্তমান সংকটের মধ্যেও এ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর কোথায় যাচ্ছে তার কোনো হিসাবও মিলছে না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, চুরি যাওয়া বিদ্যুৎ সিস্টেম লস হিসাবে দেখানো হয়। চুরি রোধে কেন কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না, তা বিদ্যুৎ সংস্থাগুলোই ভালো বলতে পারবে। বিশ্লেষকদের মতে, একটি রিকশা প্রতিদিন চার্জ বাবদ খরচ করছে পাঁচ ইউনিট বিদ্যুৎ। এই বিদ্যুৎ দিয়ে লম্বা সময় চলতে পারত একটি ছোট পরিবার।
জানা যায়, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইককে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজিসহ অবৈধ আয়ের পথ তৈরি হয়েছে। এসবের চালক ও মালিকদের কাছ থেকে আদায় করা চাঁদার টাকায় অনেকেই ফুলেফেঁপে উঠেছে। মূলত এদের সহযোগিতায় নগরীর বিভিন্ন অলিগলিতে গড়ে উঠেছে শত শত অবৈধ গ্যারেজ। ৯০ শতাংশ গ্যারেজেই ব্যবহার হচ্ছে অবৈধ বিদ্যুৎ। অধিকাংশ গ্যারেজ মালিক একটি রিকশার ব্যাটারি চার্জ করতে ১২০ টাকা করে আদায় করছে। এখান থেকে তারা চাঁদা পরিশোধ করছে। এজন্য তাদের কোনো বিল দিতে হচ্ছে না।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার ফারুক হোসেন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, সারা দেশে ৬০ লাখের বেশি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আছে। রাজধানীতে আছে প্রায় ১২ লাখ। প্রতিটি রিকশায় বৈধভাবে চার্জ দেওয়ার জন্য মাসে বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় হয়। তিনি বলেন, এসব রিকশা অলিগলিতে চলে। তবে মূল সড়কে উঠলেই ডাম্পিং করা হয়। তাছাড়া ডিএমপি একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে অবৈধ গ্যারেজ বন্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। বিভিন্ন অভিযানে ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো আটক হলেও নির্দিষ্ট টাকায় ছাড়িয়ে এনে ফের সড়কে নামানো হয় বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইকচালক সংগ্রাম পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় এই সংখ্যা ১২ লাখের বেশি। এর মধ্যে ১০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা, বাকি ২ লাখ ইজিবাইক। সংগ্রাম পরিষদের সদস্যসচিব ইমরান হাবিব রুমন বলেন, সারা দেশে ব্যাটারির রিকশায় ৪০০ কোটি টাকার ব্যাটারি প্রয়োজন। সরকার ব্যাটারি তৈরি, আমদানি ও বিক্রির অনুমতি দিয়েছে। এতে সরকার ট্যাক্স পেয়েছে, ব্যবসায়ীরা পেয়েছেন মুনাফা। কিন্তু সমস্যায় ভুগছেন শ্রমজীবী চালকরা। এ যানবাহনের যন্ত্রাংশ বৈধভাবে বিক্রি হচ্ছে। তাহলে ব্যাটারিচালিত যানবাহন রাস্তায় চললে তা অবৈধ হবে কেন, তিনি এ প্রশ্ন তুলে ধরেন।
রাজধানীর মিরপুর, পল্লবী, মুগদা, বাসাবো, হাজারীবাগ, জিগাতলা, কামরাঙ্গীরচর, দক্ষিণখান, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, বাড্ডা, জুরাইন, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, শনিরআখড়া, বাসাবো, মাদারটেকসহ রাজধানীর ছোট-বড় বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রত্যেক এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে।
মিরপুর এক নম্বর এলাকার অটোরিকশাচালক আব্দুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘মালিক বলে দিয়েছে, তুই রিকশা নিয়ে বের হ, পুলিশ ধরলে আমি দেখব।’ তিনি জানান, প্রতিদিন মালিককে ৩২০ টাকা করে জমা দেন। আর গ্যারেজে চার্জ বাবদ ১২০ টাকা মালিকই বহন করে।
পুলিশ রিকশা জব্দ করে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কয়েক দিন আগে ধরা খাইছিলাম। দারুসসালাম এলাকা থেকে ৭২০ টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে এনেছে মালিক। তিনি বলেন, রিকশা ধরলে র্যাকার করে। পরে টাকা দিলে ছেড়ে দেয়। টাকা না দিলে ডাম্পিং করে দেয়। ডাম্পিং থেকে ছাড়াতে হলে ৪ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়।
পুলিশ প্লাজা এলাকায় রিকশাচালক কামাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, গুদারাঘাট, পুলিশ প্লাজা ও মেরুল বাড্ডা এলাকার ভেতরে চালাই। মেইন রোডে গেলে পুলিশ ধরে। তিনি বলেন, কখনো পুলিশ ধরলেও মালিকদের সঙ্গে পুলিশের লিংক আছে। তারাই ছাড়ায়ে আনে।
মিরপুরের দিয়াবাড়ী, ভাসানটেক বস্তি, বেড়িবাঁধ, বাউনিয়াবাঁধ, রূপনগর, লালমাটিয়া, ৬০ ফিট রোড, শিয়ালবাড়ী, ইস্টার্ন হাউজিং, মাটিকাটা, দারুসসালাম এলাকায় বস্তি ও সরকারি খাস জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে চার শতাধিক গ্যারেজ।
প্রতিটি গ্যারেজে ৫০ থেকে ১০০ রিকশা রয়েছে। মিরপুর ১১ নম্বর লালমাটিয়া এলাকার জোড়পুকুরপাড়সংলগ্ন সরকারি খাস জায়গা দখল করে ২০-২৫টি গ্যারেজ রয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এসব গ্যারেজে অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহার হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক গ্যারেজ মালিক যুগান্তরকে জানিয়েছেন, একটি রিকশায় ৪টি ব্যাটারি থাকে। বৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে এসব ব্যাটারি চার্জ দিলে মাসে অনেক টাকা বিল আসবে।
এদিকে কামরাঙ্গীচরে চলছে প্রায় দেড় হাজার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। এ এলাকায় ছোট-বড় ৭৮টি রিকশা গ্যারেজ রয়েছে। বিদ্যুতের খাম্বা থেকে লাইন টেনে অবৈধভাবে এসব গ্যারেজে ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জ দেওয়া হয়। বাগানবাড়ী এলাকার বেশ কয়েকজন গ্যারেজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। এভাবে প্রায় প্রতিটি এলাকায়ই গ্যারেজের নিয়ন্ত্রক রয়েছেন। তারা স্থানীয় কতিপয় নেতা ও অসাধু পুলিশকে মাসোহারা দিয়েই অবৈধভাবে গ্যারেজ পরিচালনা করছেন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় কী পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয়, এর সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের কাছে নেই। তিনি বলেন, এসব অটোরিকশাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অবৈধ গ্যারেজ বাণিজ্য। অবৈধ লাইন টেনে এসব গ্যারেজ চালানো হচ্ছে। এতে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
তিনি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ এসব যানবাহন পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। তবে যারা পঙ্গু, তারা সরকারি অনুমোদন নিয়ে এই রিকশা চালাতে পারবেন। এর বাইরে কাউকে চালাতে দেওয়া ঠিক না।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা জানান, তারা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) ফরিদ আহম্মদ বলেন, পর্যায়ক্রমে আমরা রিকশার লাইসেন্স দিচ্ছি। প্রতি সপ্তাহে আমরা অভিযান পরিচালনা করছি যাতে লাইসেন্সবহির্ভূত রিকশা না চলে। আইনবহির্ভূত রিকশা পুলিশের সহায়তা নিয়ে ডাম্পিংয়ে দিচ্ছি।