বিদেশি উৎস থেকে সরকারের ঋণগ্রহণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছেই। শুধু সর্বশেষ সাড়ে সাত বছরেই বাংলাদেশের সার্বিক বিদেশি ঋণ সোয়া দুই গুণের বেশি বেড়ে ৯৩.৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। শতকরা হিসাবে এ বৃদ্ধির পরিমাণ ১২৮ ভাগ। স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত পুঞ্জীভূত বিদেশি ঋণ ছিল ৪১.১৭ বিলিয়ন ডলার। এরপর গত সাড়ে সাত বছরে বিদেশি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৫২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুসারে বিগত অর্থবছর পর্যন্ত বিদেশি ঋণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দেশের উন্নয়নে বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে অনেক। কিন্তু রাজস্ব ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ প্রয়োজনের তুলনায় কম। ঘাটতি পূরণে তাই বাড়ছে বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে গিয়েই বিদেশি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি হারে বাড়ায় বিদেশি দায়দেনার বহির্মুখী প্রবাহ আকস্মিকভাবে বাড়তে পারে। তাদের মতে, যে হারে বিদেশি ঋণ বাড়ছে, তা চলতে থাকলে সামগ্রিক আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, জিডিপির প্রবৃদ্ধির চেয়েও বেশি হারে বিদেশি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় জিডিপি-বিদেশি ঋণ অনুপাত গত সাড়ে সাত বছরে অনেক বেড়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই অনুপাত ছিল ১৫.৫ শতাংশ। আর ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০.৫ শতাংশে। বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের চলতি হিসাবে প্রাপ্তির তুলনায়ও বৈদেশিক ঋণের অনুপাত ২০১৬-১৭ সালে ছিল ৭৮.২ শতাংশ। বিগত অর্থবছর শেষে সেটি দাঁড়ায় ১১৬.৬ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের তুলনায় বৈদেশিক ঋণের অনুপাত ছিল ১২২.৫ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ২১৩.১ শতাংশ। বিবেচ্য সাত বছরের ব্যবধানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের তুলনায় স্বল্পমেয়াদি ঋণের অনুপাত ২৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩০.৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এই সাত বছরের ব্যবধানে মাথাপিছু বিদেশি ঋণ ২৫৭.৪৭ ডলার থেকে বেড়ে ৪৮২.৩৫ ডলারে উন্নীত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, সরকারি খাতের বিদেশি ঋণ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে সরকারের বিদেশি ঋণ ছিল ৬৭.২৯ বিলিয়ন ডলার, যা ডিসেম্বর ২০২২ শেষে ৬৯.৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের করপোরেশনের দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি দুই ধরনের ঋণই গত তিন মাসে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণ বিবেচ্য তিন মাসে ১.৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২.১১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৮.৯৭ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৯.০৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
তবে সরকার বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ বৃদ্ধির রাশ টেনে ধরেছে গত ছয় মাসে। জুন ২০২২ শেষে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ ছিল ২৫.৯৫ বিলিয়ন ডলার, যা সেপ্টেম্বর ২০২২ শেষে ২৫.৪০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। ডিসেম্বর ২০২২ মাস শেষে তা আরও কমে ২৪.৩০ বিলিয়ন ডলারে নামে। এ সময়ে বেসরকারি স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ ১৭.৭৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৬.৪১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
স্বল্পমেয়াদি বেসরকারি ঋণের মধ্যে বায়ার্স ঋণ জুন ২০২২-এর তুলনায় কিছুটা বেড়ে সেপ্টেম্বর ২০২২-এ ১০.১৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল, যা ডিসেম্বর শেষে কিছুটা কমে ৯.৫৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। আমদানির ঋণপত্র নিয়ন্ত্রণের কারণে বিবেচ্য ছয় মাসে ডেফার্ড এলসির দায় বেশ কমেছে। জুন ২০২২ শেষে ডেফার্ড এলসির পাওনা ছিল ১.০১ বিলিয়ন ডলার, যা ডিসেম্বর শেষে ০.৬৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। একই সময়ে বিদেশি ব্যাংকের ব্যাক টু ব্যাক এলসির পাওনা ১.১৬ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ০.৮৯ বিলিয়ন ডলারে নামে। বেসরকারি খাতের দীর্ঘমেয়াদি দায়ও বিবেচ্য সময়কালে কমে গেছে। ছয় মাসে ৮.১৯ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে এটি ডিসেম্বর ২০০২২ শেষে ৭.৮৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।