নতুন যেকোনো গণতন্ত্রমনা রাজনৈতিক দলকে স্বাগত জানাবে বিএনপি। তবে অন্তর্র্র্বর্তী সরকারের নেপথ্য পৃষ্ঠপোষকতায় কোনো দল গড়ে উঠুক তা চায় না তারা। দলটির নীতিনির্ধারণের সাথে জড়িতরা বলেছেন, এক এগারোর সময়ও বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোকে মাইনাস করার হীন উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু সেটি সফলতার মুখ দেখেনি, জনগণ গ্রহণ করেনি। বর্তমান সরকারও যদি কোনো প্ল্যাটফর্মকে মদদ দিয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে দাঁড় করানোর পেছনে কলকাঠি নাড়ে সেটিও গ্রহণযোগ্য হবে না।
এ দিকে আগামী নির্বাচন ইস্যুতেও সরকারের সাথে কোনো বিবাদে জড়াতে চায় না বিএনপি। দলটি দ্রুত নির্বাচন দাবি করে মূলত বল সরকারের কোর্টে ঠেলে দিয়েছে। সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থা বুঝে এবং সার্বিক পরিস্থিতির আলোকে একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেবে এমনটাই আশা করছেন দলটির নেতারা। তবে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়কে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যৌক্তিক সময় হিসেবে মেনে নিতে নারাজ বিএনপির হাইকমান্ড।
নতুন রাজনৈতিক দল গঠন : বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ধারা যুক্ত করতে শিগগির নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন হতে যাচ্ছে বলে বেশ কিছু দিন ধরে শোনা যাচ্ছে। রাষ্ট্র সংস্কার ও পুনর্গঠনের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি ও গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির সমন্বয়ে এই দল গঠিত হতে পারে বলে চাউর আছে। তবে দলটির নাম, নেতৃত্ব, কমিটি, গঠনতন্ত্র ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় এখনো প্রকাশ করা হয়নি। এ বিষয়ে কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
নতুন রাজনৈতিক দলে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে সরাসরি জড়িত না থাকলেও তাদের অনেকেরই অংশগ্রহণ থাকবে বলে জানা গেছে। এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বে থাকা কোনো কোনো প্রতিনিধিও নতুন দলে সম্পৃক্ত হতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
এমন সময়ে দলটি গঠন হতে যাচ্ছে যখন ছোটখাটো ও অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম শেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর দ্রুত নির্বাচনের চাপ রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর তরফ থেকে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কে প্রাথমিক একটি ধারণা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। আর সংস্কার বিলম্বিত হলে পরের বছরের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে নতুন দল গঠনের বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে রাজনৈতিক মহলে। দল গঠনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে কেউ কেউ এটিকে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য বলে অভিহিত করেছেন। তবে সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে দল গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলে শুরুতেই সেই উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, গণতন্ত্রের পথে যখন আমরা হেঁটে যাচ্ছি তখন যেকোনো রাজনৈতিক দল গঠিত হতে পারে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা, যারা নেতৃত্ব দিয়েছে, তারা যদি দল করে খুবই ভালো কথা; কিন্তু এটা যেন আবার রাজকীয় দল না হয়। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় কোনো দল গঠন করার প্রক্রিয়া যদি হয়, তাহলে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হবে। জানা গেছে, বিএনপির সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রসঙ্গ তুলেছেন কেউ কেউ। একজন নেতা বলেন, নির্বাচন বিলম্বিত করার এটিও একটি কারণ হতে পারে। বিএনপির হাইকমান্ড নতুন যেকোনো রাজনৈতিক দলকে স্বাগত জানাতে চায়। তবে সে ক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা দেখতে চায় না।
নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপে জটিলতা কাটতে পারে : নির্বাচন নিয়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সময় যত অতিবাহিত হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ‘সুনির্দিষ্ট’ নির্বাচনী রোডম্যাপের চাপ ততই বাড়ছে। ২০২৫ সালেই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব বলে মনে করে বিএনপি। নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য এটিই ‘যৌক্তিক সময়’ বলে মনে করে দলটি। তাদের চাওয়া, ’২৫ সাল যেন অতিক্রম না হয়। শরিকদেরও একই অভিমত। বিএনপি ও শরিকরা মনে করে, নির্বাচন ২০২৬ সালে গেলে সেটি হবে ‘অযৌক্তিক’। এর পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণ আছে বলে তারা মনে করে না। তাদের অভিমত, এর মধ্য দিয়ে শুধু সময়ক্ষেপণ হবে- যেটি প্রত্যাশিত নয়। কারণ, দীর্ঘ দিন ধরে ভোটাধিকারবঞ্চিত মানুষ এখন ভোট দিতে উন্মুখ। সে জন্য দলগুলো কোনো ধারণা নয়, নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চায়।
বিএনপি মনে করে, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের জন্য চার-পাঁচ মাস সময় প্রয়োজন। ফলে নির্বাচনের জন্য ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায় না দলটি। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হলে তাতে আপত্তি থাকবে না বিএনপির। তাদের অভিযোগ, দেশে এখন ‘পতিত’ ফ্যাসিবাদের দোসরদের নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। এই ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকতে পারে। তা ছাড়া দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, অর্থনীতিতে গতি আনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসনে এখনো স্থিতিশীলতা আসেনি বলে মনে করে বিএনপি।
দলটি আরো মনে করে, দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রসহ নানা ঘটনায় দেশে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা মনে করে, দেশবিরোধী সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা এবং দেশকে স্থিতিশীল করতে নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপেই কাটতে পারে নির্বাচনকেন্দ্রিক জটিলতা বা সংশয়। নির্বাচন যত দেরি হবে, সঙ্কট ততই বাড়বে বলে মনে করে বিএনপি।
জানা গেছে, ২০২৫ সালেই নির্বাচন আদায়ে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গত দু-এক মাস ধরে রোডম্যাপের দাবিতে সোচ্চার থাকা বিএনপি। এ লক্ষ্যে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার চিন্তাভাবনা করছে দলটি। তবে এর দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত না হলেও আগামী ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ সারা দেশে বড় বড় সভা-সমাবেশ করতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা মনে করি, ২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। নির্বাচন যত বিলম্ব হবে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য পথচলা তত কঠিন হবে। সে জন্য সরকার তাদের দক্ষতা-ক্ষমতা এবং অন্যান্য বিষয় মিলে যত দ্রুত নির্বাচন দিয়ে জনগণের নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারবে, ততই এই সরকার ও দেশের জন্য মঙ্গল হবে।’