আগামী ২৬ নভেম্বর রওশন এরশাদ কর্তৃক জাতীয় পার্টির দশম জাতীয় কাউন্সিল আহ্বান এবং সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হওয়া নিয়ে দলটিতে এখন চরম অস্থিরতা চলছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের নেতৃত্বে বর্তমান কমিটির মেয়াদপূর্ণ হওয়ার আগেই জাতীয় কাউন্সিল আহ্বান করা নিয়ে এই অস্থিরতার সূত্রপাত। গত ১ সেপ্টেম্বর সংসদীয় কমিটির সভা করে দলের ২৬ জনের মধ্যে ২৩ সংসদ সদস্য বিরোধী দলীয় উপনেতা জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করার প্রস্তাবে সম্মত হন। প্রস্তাবনার এ চিঠি দেয়া হয় স্পিকারকে। এতদিন অতিবাহিত হলেও এখনো এ বিষয়ে সুরাহা হয়নি। স্পিকারও কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি।
জাপা সূত্র জানায়, শীর্ষনেতাদের ২-১ জন তলে তলে রওশন এরশাদের সাথে লিয়াজোঁ করে চলছেন বটে; কিন্তু অধিকাংশ শীর্ষনেতা ও দলীয় এমপিই জি এম কাদেরের পক্ষে। দলছুট ও বহিষ্কৃতদের একত্র করার মিশনে নেমেছেন রওশনপন্থীরা। কিন্তু হালে পানি পাচ্ছে না। ফলে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন জি এম কাদের। বেকায়দায় পড়েছেন রওশন এরশাদ। এ অবস্থায় আগামী ৩০ অক্টোবর বসছে চলতি সংসদের ২০তম অধিবেশন। এই অধিবেশন শুরুর আগেই জাতীয় পার্টির চলমান দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছে।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য পদ হারানো বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙা নয়া দিগন্তকে বলেন, আগামী ২৯ অক্টোবর ম্যাডাম দেশে ফিরছেন। ৩০ অক্টোবর সংসদে যোগ দিচ্ছেন। এটিই এখন তার জানা সর্বশেষ খবর। সংসদ অধিবেশনে যোগদানের আগেই সংসদীয় কমিটির সভা করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, তবে এই সভা আহ্বানের এখনো নির্দেশ পাইনি। তিনি (রওশন এরশাদ) নির্দেশ দিলেই সভা ডাকব।
এ দিকে, বিভিন্ন মাধ্যমে ইতোমধ্যে চাউর হয়েছে জি এম কাদের বিরোধীদলীয় নেতা হচ্ছেন। উপনেতা হচ্ছেন সিনিয়র কো চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। আর বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ হচ্ছেন ময়মনসিংহের সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম। সংসদ সচিবালয় সূত্রে জি এম কাদের পন্থীরা এমন খবর ছড়াচ্ছেন। তবে স্পিকার কিংবা সংসদ সচিবালয় থেকে এ ধরনের কোনো তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তবে মসিউর রহমান রাঙা নয়া দিগন্তকে বলেন, এটা রটনা মাত্র। এ ধরনের খবর সঠিক নয়। ম্যাডাম দেশে আসার পরই সব কিছু জানতে পারবেন। জাপা মহাসচিব মো: মুজিবুল হক চুন্নু নয়া দিগন্তকে বলেন, সংসদীয় কমিটির সভার সিদ্ধান্ত আলোকে আমরা জি এম কাদের সাহেবকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে নির্বাচন করে স্পিকারকে চিঠি দিয়েছিলাম। স্পিকার মহোদয় এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত জানাননি। আমরা তার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। তবে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের বিরোধীদলীয় উপনেতা এবং ফখরুল ইমামের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ করার খবর সঠিক নয়; এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান মহাসচিব।
জি এম কাদেরের পক্ষ ত্যাগ করা বিরোধীদলীয় উপনেতা মসিউর রহমান রাঙা ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা তো দূরে থাক, আসন্ন সংসদ অধিবেশনে রওশন এরশাদের পাশের চেয়ারই (উপনেতা) থাকছে না জি এম কাদেরের জন্য। সেখানে অন্য কেউ বসছেন। এমনকি জাতীয় পার্টির অফিস থেকেই বের করে দেয়ার হুমকি দেন তিনি। রাঙার এই বক্তব্যকে পাত্তা দিচ্ছে না জাতীয় পার্টি। গত মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে রাঙার কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে পার্টির নেতাকর্মীরা। জি এম কাদেরকে নিয়ে জাপার সাবেক মহাসচিব রাঙার বক্তব্যকে কুরুচিপূর্ণ উল্লেখ করেন নেতারা। দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক সফিকুল ইসলাম সেন্টুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই বিক্ষোভে প্রধান অতিথি ছিলেন আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহিদুর রহমান টেপা। তিনি বলেন, যখনই জাতীয় পার্টি ঘুরে দাঁড়ায় তখনই পার্টির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি এখন দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে কথা বলছেন। জাতীয় পার্টি দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। এ কারণেই একটি কুচক্রি মহল জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। যারা দালালি করবে, জাতীয় পার্টিতে তাদের জায়গা হবে না। জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা কারো ষড়যন্ত্রে বিভ্রান্ত হবে না।
সফিকুল ইসলাম সেন্টু বলেন, মসিউর রহমান রাঙাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। রাঙা প্রকাশ্যে ক্ষমা না চাইলে, তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেয়া হবে। রাঙা যে ভাষায় বক্তৃতা করেছেন তা আমাদের রুচিতে বাধে। কিন্তু জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা নোংড়ামীর জবাব দিতে জানে। জাতীয় পার্টিতে থেকে কেউ দালালি করলে সে কখনোই ক্ষমা পাবে না। প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, জহিরুল ইসলাম জহির, নাজমা আখতার এমপিসহ অনেকে বক্তব্য রাখেন।
জাপার জি এম কাদের পন্থী এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, চলতি একাদশ সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ মারা যাওয়ার পর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এবং সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার আসন নিয়ে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন জি এম কাদের ও রওশন এরশাদ। শেষ পর্যন্ত এরশাদপতœী রওশনকে বিরোধীদলীয় নেতার আসন ছেড়ে দিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের পদ পাকাপোক্ত করেন জি এম কাদের। একই সাথে এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া রংপুর সদর আসনটি রওশনপুত্র সাদ এরশাদকে ছেড়ে দিতে হয়। তিনি বলেন, থাইল্যান্ডে দীর্ঘ দিন ধরে চিকিৎসাধীন রওশন এরশাদ বর্তমান কমিটির মেয়াদ থাকা অবস্থায়ই কেন যে সম্মেলন আহ্বান করলেন তা শীর্ষ মহলের অজানা। দলের পদ হারানো এবং বঞ্চিত একটি অংশ সাদ এরশাদকে ম্যানেজ করে রওশন এরশাদকে দিয়ে নানা নির্দেশনা জারি করছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
জাতীয় পার্টির আরেক নেতা বলেন, এখন পর্যন্ত দলে জি এম কাদেরের অবস্থান খুবই শক্ত। শীর্ষনেতৃবৃন্দ এবং দলীয় এমপিদের বেশির ভাগই তার পক্ষে। ফলে রওশন পন্থীরা হালে পানি পাচ্ছেন না। এখন সঙ্কটটা দেখা দিয়েছে ২৬ নভেম্বর রওশন ঘোষিত কাউন্সিল নিয়ে। জি এম কাদের মনে করেন এটি রওশন এরশাদকে দিয়ে করানো হয়েছে। তিনি বাধ্য হয়েছেন। দল আবার ব্রাকেটবন্দী হোক রওশন এরশাদ চান না। এ অবস্থায় জি এম কাদেরও ভাবির প্রতি কঠোর নন।
তাহলে কিভাবে সমাধান হচ্ছে জানতে চাইলে এই নেতা বলেন, অতীতের মতোই হয়তো এর সমাধান হবে। হতে পারে রওশন এরশাদ ২৬ নভেম্বর কাউন্সিল বাতিল বা স্থগিত করলেন। তিনিই বিরোধীদলীয় নেতার পদে থাকলেন। তবে, যেটা মনে হচ্ছে জিএম কাদেরের দিক থেকে সব ধরনের প্রস্তুতিই রয়েছে। যেহেতু শীর্ষনেতৃবৃন্দ এবং এমপিরা তার সাথে রয়েছেন, তাই তিনি যেভাবে চাইবেন, সেটাই হবেন। রওশন পন্থীরাই মূলত চাপে পড়ছেন। সমঝোতা ছাড়া রওশন এরশাদের পথ নেই।
জি এম কাদের ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা বলেন, রওশনপন্থীরা মনে করেছিলেন, সরকার জাতীয় পার্টির বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে। কিন্তু সরকারের শীর্ষ মহল থেকে ওইভাবে হস্তক্ষেপ করা হয়নি। আর করা হবে বলেও মনে হচ্ছে না। ফলে যারা রওশন এরশাদকে দিয়ে এসব করাচ্ছেন তারা হালে পানি পাচ্ছেন না।