অধিক বিনিয়োগ ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়াতে সঞ্চয়পত্র খাতে বড় ধরনের সংস্কার আনা হচ্ছে। এর মধ্যে বহুলপ্রচলিত ‘পেনশন সঞ্চয়পত্র’ ক্রয়সীমা ৫০ লাখ থেকে বাড়িয়ে এক কোটি টাকা করা হচ্ছে। ‘পরিবার সঞ্চয়পত্রে’ পুরুষ ক্রেতার বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৫০ বছরে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বেশিসংখ্যক পুরুষ পরিবার সঞ্চয়পত্র কেনার আওতায় আসতে পারবেন। এছাড়া ‘বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে’ যাতে বেশিসংখ্যক প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করতে পারে, এ লক্ষ্যে বিদ্যমান ক্ষেত্রগুলো পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে।
সম্প্রতি এসব প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে পাঠিয়েছে জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর। ওই প্রস্তাবে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের তিন মাস অন্তর মুনাফা দেওয়ার বিধান তুলে দিয়ে এক মাস অন্তর কার্যকরের সুপারিশ করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মো. শাহ আলম যুগান্তরকে বলেন, পেনশন সঞ্চয়পত্র কেনার সিলিং এবং পরিবার সঞ্চয়পত্র কেনার (পুরুষ ক্রেতা) বয়স কমানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এখন মন্ত্রণালয় এবং সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। সেখান থেকে অনুমোদন করলে তা কার্যকর হবে। তিনি আরও বলেন, তিন মাস অন্তর যেসব সঞ্চয়পত্রের মুনাফা দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো প্রতিমাসে দেওয়ার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সম্প্রতি পরিদর্শন করেছেন জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর। ওই সময় এসব বিষয় তুলে ধরেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। বিষয়গুলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব প্রস্তাব আকারে পাঠানোর কথা বলেন। সে আলোকে জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর সঞ্চয়পত্রের খাতওয়ারি সংস্কারের প্রস্তাব করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, সঞ্চয়পত্র খাতে প্রস্তাবগুলো ইতিবাচক দৃষ্টিতে বিবেচনা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে দেশের অর্থনীতি, সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন প্রাপ্যতা, সঞ্চয়পত্র ক্রেতার সংখ্যা-সবই বেড়েছে। কিন্তু এ খাতের বিধিবিধান নিয়মগুলো পরিবর্তন করা হয়নি। যদিও এসব বিধিবিধান অনেক আগে প্রণয়ন করা। এখন এগুলো যুগোপযোগী করা হবে।
জানা যায়, বর্তমানে যদি কোনো পুরুষ পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনতে চান, সেক্ষেত্রে তার বয়স ৬৫ বছর বা এর চেয়ে বেশি হতে হবে। কিন্তু একজন সরকারি চাকরিজীবী ৫৯ বছরে অবসরে যান। কিন্তু বয়সসীমা বেশি থাকায় পেনশনের টাকা দিয়ে পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছেন না। একই সমস্যা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রেও হচ্ছে। এছাড়া বর্তমান সরকারের গড় আয়ু হিসাবে ৬৫ বছরে আগে অনেকে মারা যান। আর বেঁচে থাকা মানুষগুলোর ওই বয়সে পৌঁছানোর পর টাকার খুব বেশি প্রয়োজন হয় না। সবদিক বিবেচনা করে পরিবার সঞ্চয়পত্র কেনার বয়সসীমা ৬৫ থেকে কমিয়ে ৫০ বছরে নামিয়ে আনার যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর।
প্রসঙ্গত, এখন পরিবার সঞ্চয়পত্র সর্বনিম্ন ১০ হাজার এবং সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকার কেনা যায়। এ সঞ্চয়পত্র বাংলাদেশি নাগরিক ১৮ বছর বা এর বেশি মহিলা, শারীরিক প্রতিবন্ধী পুরুষ ও মহিলা এবং ৬৫ বছর ও তার বেশি পুরুষ ও মহিলা কিনতে পারেন। সূত্রমতে, পেনশন সঞ্চয়পত্রের ক্রয়সীমা ৫০ লাখ থেকে বাড়িয়ে এক কোটি টাকা করা হচ্ছে। অথবা একজন চাকরিজীবী অবসরে যাওয়ার পর তার ভবিষ্যতহবিল ও আনুতোষিক মিলে মোট যে টাকা, এর সমপরিমাণ দিয়ে কিনতে পারবেন পেনশন সঞ্চয়পত্র। উল্লিখিত দুটির যে কোনো একটি সুযোগ নিতে পারবেন এক পেনশন সঞ্চয়পত্র ক্রেতা। এমন প্রস্তাব অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ দিয়েছে।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, পেনশন সঞ্চয়পত্র কেনার সিলিং যখন নির্ধারণ করা হয়, ওই সময় সরকারি চাকরিজীবীদের বেতনভাতার অঙ্ক কম ছিল। এরপর ২০০৯ এবং ২০১৫ সালে চাকরিজীবীদের দুটি পে-স্কেল দিয়েছে সরকার। এখন একজন দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা অবসরে গেলে আনুতোষিক ৫০ লাখ টাকার ওপরে পাচ্ছেন। এর সঙ্গে ভবিষ্যতহবিল যোগ করলে তা এক কোটি টাকার বেশি হচ্ছে। কিন্তু পেনশন সঞ্চয়পত্র কেনার সিলিং কম থাকায় অবসরে যাওয়া চাকরিজীবীরা পেনশনের পুরো টাকা দিয়ে ইচ্ছা থাকলেও এ সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছেন না।
এছাড়া একজন চাকরিজীবী অবসরে গেলে তার বেতন ৬৫ শতাংশ কমে যায়। যিনি ৩০ হাজার টাকা বেতন পেয়েছেন, পেনশনে গেলে পরের মাস থেকে পাবেন ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। তার ঘাটতি মেটানোর কোনো সুযোগ থাকে না। অথচ এ সময়ে তার খরচও কমছে না। যদিও বিনিয়োগের জন্য শেয়ারবাজার বা ব্যাংক আছে। কিন্তু পুঁজিবাজারের ঝুঁকি নিয়ে অনেকে বিনিয়োগ করতে সাহস পান না। ব্যাংকে আমানতের সুদ কম থাকায় সেখানেও বিনিয়োগ করেন না। আয়ের ঘাটতি মেটাতে পেনশনের টাকা দিয়ে একমাত্র সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন বেশি। কারণ, এ খাতটিকে তারা নিরাপদ মনে করেন। এজন্য পেনশন সঞ্চয়পত্রের ক্রয়সীমা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, বর্তমান পেনশন সঞ্চয়পত্র একক নামে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত কেনা যায়। তবে সে অর্থের পরিমাণ আনুতোষিক ও সর্বশেষ ভবিষ্যতহবিল থেকে প্রাপ্ত অর্থের বেশি নয়।
এদিকে প্রাতিষ্ঠানের ভবিষ্যতহবিল ও ব্যবসাবাণিজ্যের আয় দিয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। এ বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলো পুনর্বিন্যাস করার প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর। বর্তমান আয়কর বিধিমালায় স্বীকৃত ভবিষ্যতহবিলের ৫০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫০ কোটি টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করার বিধান আছে। খাতগুলো হচ্ছে মৎস্য, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, ব্যাঙ, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য, রেশম গুটিপোকা পালনের খামার, পোলট্রি ফিডস উৎপাদন এবং বীজ উৎপাদন প্রতিষ্ঠান। এছাড়া স্থানীয় উৎপাদিত বীজ বিপণন, উদ্যান প্রকল্প, ছত্রাক উৎপাদন এবং ফল ও লতাপাতার চাষ থেকে অর্জিত আয় দিয়ে বিনিয়োগ করা যায়। তবে সে আয় সংশ্লিষ্ট উপকর কমিশনার কর্তৃক প্রত্যয়নকৃত হতে হবে।
সূত্রমতে, এসব ক্ষেত্র থেকে কিছু বাতিল করা হবে। পাশাপাশি বর্তমানে অনেক নতুন ক্ষেত্র অন্তর্ভুক্ত হবে। সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বিধিবিধানে না থাকায় অনেক নতুন প্রতিষ্ঠানের আয় দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনা যাচ্ছে না। সঞ্চয়পত্রে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের ক্ষেত্র পুনর্বিন্যাসের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বর্তমান চারটি সঞ্চয়পত্রের মধ্যে শুধু ‘পরিবার’ সঞ্চয়পত্রের মুনাফা দেওয়া হয় প্রতি মাস অন্তর। এছাড়া ‘তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক’ সঞ্চয়পত্র, পেনশন সঞ্চয়পত্র ও পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফা দেওয়া হয় প্রতি তিন মাস অন্তর। সংশ্লিষ্টরা জানান, তিন মাসের একসঙ্গে মুনাফা না দিয়ে প্রতিমাসে দেওয়া হলে উপকারভোগী তা কাজে লাগাতে পারবেন। এক্ষেত্রে সুদহার ঠিক রেখেই প্রতিমাসে মুনাফা দেওয়ার বিধান চালু করা হবে।
এছাড়া ম্যানুয়ালি ইস্যুকৃত পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের ডুপ্লিকেট ইস্যুও ম্যানুয়ালি করা যাবে। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত মতামত অর্থ বিভাগের কাছে পাঠিয়েছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। এর আগে অর্থ বিভাগ থেকে এ বিষয়ে মত চাওয়া হয়েছিল।
জানা যায়, বর্তমান বিনিয়োগের ক্ষেত্র পুঁজিবাজারে সবেচেয়ে খারাপ অবস্থা চলছে। সুদের হার একক অঙ্কে নামিয়ে আনায় ব্যাংকে টাকা রেখে ৪ থেকে ৫ শতাংশ হারে স্বল্প সুদ পাচ্ছেন আমানতকারীরা। কিন্তু মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ বিরাজ করায় ব্যাংকের আমানতের সুদ খেয়ে ফেলছে মূল্যস্ফীতি। তবে বিনিয়োগের জন্য একমাত্র সঞ্চয়পত্রে সবচেয়ে বেশি সুদ পাওয়া যাচ্ছে। যে কারণে অনেকে বেশি মুনাফার আশায় সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছেন। কিন্তু এর বিনিয়োগসীমা অনেক আগে নির্ধারিত ছিল। ফলে বর্তমানে অনেকে বেশি অঙ্কের বিনিয়োগ করতে পারছেন না।
উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) সরকার ৩৫ হাজার কোটি টাকা সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। আগের অর্থবছরে বিক্রি করা হয় ৩২ হাজার কোটি টাকা।