সোমবার, ১২:৪১ পূর্বাহ্ন, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।
শিরোনাম :

সঙ্গীর দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় কি ভালোবাসা হারিয়ে যায়?

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
  • ৪৫ বার পঠিত

একজনের কোনো দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা আছে ও আরেকজন সুস্থ-স্বাভাবিক, এমন দম্পতিকে আশপাশের মানুষ কেমন দৃষ্টিতে দেখে? অধিকাংশ মানুষের চোখেই থাকে সহানুভূতির ছাপ। কেউ কেউ দুঃখমিশ্রিত হাসিতে বলে দেয় ‘আহারে বেচারা!’। হয়তো দুজনকেই।

তারা হয়তো এই অসুস্থতা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে ওই দম্পতির সীমাবদ্ধতাগুলোকে খুব সহজভাবে গ্রহণ করে এবং যখন সম্ভব হয় তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করে। কিন্তু  প্রশ্ন হলো,অসুস্থ মানুষটির সঙ্গীটি আসলে কীভাবে তাকে দেখছে? তাকে তো সবসময় অসুস্থ সঙ্গীর পাশে থাকতে হচ্ছে, তার স্বাভাবিক জীবন হচ্ছে না অন্যদের মতো, তাকে দায়িত্বও নিতে হচ্ছে বেশি। এসব কারণে সঙ্গীর দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় তার প্রতি কি ভালোবাসা কমে গেছে বা যাচ্ছে?

গল্পটা ২৯ বছর বয়সী রেবেকার (ছদ্মনাম)। ৬ বছর ধরে পোস্টরাল টাকিকার্ডিয়া সিন্ড্রম রোগে আক্রান্ত তিনি। বসা অবস্থা থেকে উঠতে গেলেই মাত্রার চেয়ে অনেক কম রক্ত তার হৃদপিণ্ডে পৌঁছায়। এর ফলে খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট ও বুকে ব্যথা শুরু হয়। খাওয়া থেকে শুরু করে গোসল, টয়লেটে যাওয়া সব কাজেই তাকে সঙ্গীর সাহায্য নিতে হয়। চলাফেরা করতে হয় হুইল চেয়ারে।

রেবেকা জানান, প্রথম প্রথম বিষয়টা মেনে নেওয়া খুব কঠিন ছিল তাদের জন্য। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন তারা ৯ বছর আগে। খুব সুন্দরভাবে চলছিল তাদের জীবন। দুজনই চাকরি করতেন। একসঙ্গে বাসায় ফিরতেন। একসঙ্গেই হতো রান্নাবান্না, টেলিভিশন দেখা। ছুটির দিনে ঘুরতে যেতেন বা সিনেমা হলে একসঙ্গে মুভি দেখতেন।

হঠাৎ অসুস্থ হওয়ার পর এসবের কিছুই আর আগের মতো সম্ভব ছিল না। প্রথম দিকে রেবেকার মধ্যে ভয় কাজ করতে শুরু করে। যদি সঙ্গী তাকে ছেড়ে চলে যান? শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি তাই সবসময় খুব মানসিক অশান্তিতে ভুগতেন তিনি। মনে হতো, এই বুঝি চলে গেলেন তার ভালোবাসার মানুষটি।

এরপর খুব অপরাধবোধ কাজ করত। আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা যাই হোক না, নারী-পুরুষ সমান সমানে বিশ্বাসী ছিলেন তারা। তাই বিয়ের পর রান্নাবান্না থেকে শুরু করে ঘরের সব কাজ দুজন ভাগাভাগি করে করতেন। কিন্তু অসুস্থ হওয়ার পর যখন সব কাজে সঙ্গীর ওপর নির্ভরশীল হতে হলো, খুব খারাপ লাগত রেবেকার। মানসিক চাপ অনুভব করতেন।

তার ভালোবাসার মানুষটি যেন মনের কথা বুঝতে পেরেছিলেন। একদিন তিনি রেবেকাকে বললেন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আর এত চাপ নেওয়ারও কিছু নেই। সঙ্গী সবসময় তার পাশে আছেন-এটুকু কথাতেই যেন প্রাণ ফিরে পেলেন রেবেকা।

রান্না বা ঘরের কাজে শারীরিক শ্রম দিতে না পারলেও অন্য কাজের মাধ্যমে সঙ্গীকে সাহায্য করা শুরু করলেন তিনি। যেমন- সংসারে কী কী লাগবে তার তালিকা তৈরি করা, কোন কোন শপিং মল বা রেস্টুরেন্টে ডিসকাউন্ট চলছে বা এ বছর নতুন কী কী মুভি এসেছে, দুজন মিলে কোনটা কোনটা দেখবেন তা ঠিক করতেন তিনি।

রেবেকা বলেন, ‘অসুস্থ হলে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে। সবকিছুতে আগের মতো স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে না।’

 এই বিষয়টা খুব মিস করেন তিনি।

‘কঠিন সময়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য আর কি করেছেন?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে রেবেকা জানান, ‘অসুস্থ হওয়ার পর আমাকে সবকিছুতেই খুব নিয়ম মেনে চলতে হতো। তারপরও ভালোলাগার বিষয়গুলোকে সবসময় খুব প্রাধান্য দিতাম আমরা। যেমন- খাওয়া, গান শোনা, মুভি দেখা। ঘরে বসে যা যা করা যায়, তার সবকিছুই করার চেষ্টা করতাম। যেমন ভিডিও গেম, লুডু বা দাবা খেলা। কখনো কখনো বাইরে থেকে খাবার অর্ডার দিতাম। একটু সুস্থ বোধ করলে বাইরে বের হতাম, দুজনের প্রিয় কোনো রেস্টুরেন্টে বা পার্কে ঘুরতাম আমরা।’

দাম্পত্য সম্পর্কের বিষয়ে রেবেকা জানান, সুস্থ বোধ করলে সপ্তাহে দু-একদিন হয়তো তারা ঘনিষ্ঠ সময় কাটান। দুজনেই এ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন এবং এক্ষেত্রে তারা সুখীও।

‘তবে যখন ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করি আর দেখি যে আমার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে তখন খুব হতাশ লাগে। মাঝেমাঝে ঝগড়াও করতাম আমরা। আমি তাকে বলতাম চলে যেতে, নতুন জীবন শুরু করতে। কিন্তু সে আমাকে সবসময় সান্ত্বনা দিত, আশার বাণী শোনাত। আমাকে দুঃখী বা কাঁদতে দেখলে একদমই সহ্য করতে পারত না। বলত, এই অসুস্থার কারণেই নাকি আজ আমরা এত বেশি সময় কাছাকাছি থাকতে পারছি’, রেবেকা বলেন।

‘সত্যি বলতে কী, দীর্ঘদিন অসুস্থ হওয়ায় কারণে নতুন এক ধরনের ঘনিষ্ঠতায় পৌঁছে গেছি আমরা। সেটা আমরা আগে কখনো অনুভব করিনি’, যোগ করেন তিনি।

রেবেকার মতে, অসুস্থ হলে ভালেবাসা খোঁজার আলাদা কোনো কৌশল নেই। দুজনের যদি পরস্পরের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকে, নতুন কিছু শেখা বা জানা বা নতুন কষ্টের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার মানসিক শক্তি থাকে, তাহলে ভালোবাসাও থাকে।

দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা রোমান্টিক সম্পর্কে কী ধরনের প্রভাব ফেলে এ নিয়ে মার্কিন স্বাস্থ্যবিষয়ক ডিজিটাল পত্রিকা হেলথ সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা যায়, সঙ্গী ৫ বছর ধরে অসুস্থ এমন ৮৫ শতাংশ সঙ্গী অসুস্থতাকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন এবং সঙ্গীর সঙ্গেই আছেন। বিভিন্ন মানুষের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে ৭টি বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে সংবাদমাধ্যমটি। সেগুলো হলো-

১. ঠিক কখন আপনি আপনার অসুস্থতার কথা সঙ্গীর সঙ্গে শেয়ার করবেন

২. দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার প্রধান সমস্যা সুস্থ সঙ্গীর চেয়ে দুর্বল বোধ করা

৩. অসুস্থতার কারণে অপরাধবোধে ভোগা

৪. একজন সহানুভূতিশীল সঙ্গীই হতে পারেন `গেম চেঞ্জার’

৫. ঘরের সব কাজ করার মধ্য দিয়ে বিরক্তি নয়, ভালোবাসা প্রকাশ করা

৬. ঘনিষ্ঠতা বা দাম্পত্য সম্পর্কের অনেক অর্থ আছে, সেটা বুঝতে চেষ্টা করা

৭. সব বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা ও একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া

ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষ করে এখন প্রাপ্তবয়স্কদের জীবনের নানা সমস্যা নিয়ে কাজ করা কেটি উইলার্ড ভির‌্যান্ট বলেন, ‘দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা অবশ্যই সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জ করে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমরা বিয়ের সময় সবাই শপথ করি যে, অসুস্থতাসহ যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে একে অপরের পাশে থাকব। বাস্তবে ব্যাপারটা কঠিন হয়ে যায় যখন সঙ্গী দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়।

দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ব্যক্তি কেবল তার নিজেকে নয়, যারা তাকে ভালোবাসেন, তার সঙ্গে বসবাস করেন, প্রত্যেকটা মানুষকেই প্রভাবিত করেন। এক ব্যক্তি আমাকে বলেছিলেন, তার স্ত্রী অসুস্থতার সঙ্গে বেঁচে আছেন, তিনিও তার সঙ্গে আছেন। বলতে গেলে তিনিও এক ধরনের অসুস্থতার সঙ্গে বেঁচে আছেন ‘

এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অসুস্থ ব্যক্তির পাশাপাশি তার সঙ্গীর জন্য প্রয়োজনীয় এমন বেশ কিছু বিষয়কে খুব প্রাধান্য দিয়েছেন এবং এগুলো অভ্যাস করা বা মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। সেগুলো হলো-

১. অসুস্থ ব্যক্তির সঙ্গীর খারাপ লাগার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া। গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সঙ্গী যে তার অসুস্থ স্ত্রী বা স্বামীকে বোঝা মনে করছেন সেটা ভয়ে বলতে পারছেন না। আশপাশের মানুষের অবহেলা বা উপেক্ষাও মেনে নিতে পারছেন না তিনি।

২. অসুস্থ ব্যক্তির সঙ্গীর চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপারে সচেতন থাকা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অসুস্থ ব্যক্তি নিজেকে স্বার্থপর ভাবছেন, কোনো কাজ না করার কারণে অপরাধবোধে ভুগছেন। এসব ক্ষেত্রে অসুস্থতা সীমাবদ্ধতা তৈরি করলেও সঙ্গীর প্রয়োজন সম্পর্কে আপনাকে সচেতন থাকতে হবে। প্রয়োজনে সৃজনশীল কোনো উপায়ে তার চাহিদা পূরণের চেষ্টা করুন।

৩. সঙ্গীর একাকিত্ব বা বিষণ্ণতা কাটানোর চেষ্টা করা। দেখা যায়, ছুটির দিনে সঙ্গী হয়তো আপনার সঙ্গেই বাড়িতে বসে আছেন। আপনার সঙ্গে তিনিও সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছেন অজান্তে। এর ফলে সম্পর্ক আরও খারাপ হতে পারে। তাই সঙ্গীকে তার অফিস কলিগ বা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ঘুরতে যেতে উৎসাহিত করবেন। কিংবা তার কোনো শখের কাজ বা জিমে যেতে উৎসাহ দিতে পারেন।

৪. ঘনিষ্ঠতা বা অন্তরঙ্গ সময় নিয়ে নতুন দৃষ্টিতে ভাবা। রোমান্স মানেই প্যারিসে ঘুরতে যাওয়া বা ঘনিষ্ঠতা মানেই শুধু একান্ত সময় কাটানো, এমন ভাবনা থেকে বের হয়ে আসুন। আরও অনেক ভালোলাগার বিষয় আছে। দুজনে খোলাখুলি কথা বলে তা খুঁজে বের করুন। যেমন- ইচ্ছার কথা জানিয়ে সঙ্গীকে চিঠি লিখতে পারেন। কোনো এক রাত হতে পারে ‘নেটফ্লিক্স অ্যান্ড চিল’। মোট কথা একে অন্যের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিন।

৫. সঙ্গীর কাছ থেকে যত্ন আপনার প্রাপ্য, এমন ভাবনা থেকে বের হয়ে আসুন। সঙ্গীর যত্নের বিনিময়ে আপনি তাকে সম্মান দিয়ে পুরস্কৃত করুন। তার ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করুন। মাঝেমাঝে তার পছন্দের কিছু উপহার দিন। একইসঙ্গে কর্মক্ষেত্রে বা সামজিক জীবনে তিনি কী কী খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন সেগুলো জানতে চান, তাকে পরামর্শ দিন।

তবে প্রায় অধিকাংশ এ ধরনের দম্পতির মতে, দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ একজন ব্যক্তি ও একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের ভালোবাসার সম্পর্ক কেমন হতে পারে, সেটা বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব নয়। শুধু যারা এ অভিজ্ঞতা মধ্য দিয়ে গেছেন তারাই বলতে পারবেন ভিন্নধর্মী এই ভালোবাসার গল্প।

তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, সাইকোলজি টুডে

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com