বিভাগের ছয়টি জেলা হাসপাতালের চারটিকে ১০০ থেকে আড়াই শ শয্যায় উন্নীত করে বড় বড় অবকাঠামো ও আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়েছে।
হাসপাতাল প্রশাসন জানায়, এ হাসপাতালে অন্তর্বিভাগে ১৭টি এবং ১৭টি বহির্বিভাগ ছিল। কিন্তু ২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বহির্বিভাগে নতুন চারটি ও অন্তর্বিভাগে তিনটি বিভাগ যুক্ত হয়েছে। এখন অন্তর্বিভাগে ২০টি, বহির্বিভাগে ২১টি ইউনিট রয়েছে। নতুন চারটি বহির্বিভাগ হচ্ছে— ভাসকুলার সার্জারি, কার্ডিওলজি, ইউরোলজি ও গ্যাস্ট্রোলজি। এ ছাড়া তিনটি অন্তর্বিভাগ হচ্ছে নিউরোলজি, ডায়াবেটিক ও বার্ন ইউনিট। আরো আছে জরুরি বিভাগ।
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রোগী ভর্তি এবং মৃত্যুর পরিসংখ্যান এ প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে। সেই পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হাসপাতালে এক বছরে ১৪ লাখ ৫৭ হাজার ৩৬২ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তর্বিভাগে পাঁচ লাখ ৫৮ হাজার ৫৭ জন এবং জরুরি বিভাগে দুই লাখ চার হাজার ৭৬৯ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।
তবে অন্তর্বিভাগ এবং জরুরি বিভাগের বাইরে সবচেয়ে বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন বহির্বিভাগে। এই বিভাগের ২০টি ইউনিটে এক বছরে ছয় লাখ ৯৪ হাজার ৫৩৬ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। সে হিসেবে ৫০০ শয্যায় হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ৯০২ রোগী ভর্তি হচ্ছেন। পাশাপাশি চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে গত এক বছরে সাত হাজার ১৩৭ জন রোগীর মৃত্যু ঘটেছে। পরিসংখ্যান বলছে, ভর্তীকৃত রোগীদের মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ ভর্তি হওয়া রোগীর এক শতাংশ মারা যায়।
মৃত্যুর কারণ উল্লেখ নেই
হাসপাতালটিতে ২০২৪ সালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাত হাজার ২৩৭ রোগীর মৃত্যু হয়েছে। তবে এ প্রতিবেদককে যে তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে, সেটি শুধু সংখ্যা। সেখানে নারী, পুরুষ কিংবা শিশুর বিষয়টি পৃথকভাবে উল্লেখ নেই। কর্তৃপক্ষ বলছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৩টি বিষয়কে দুর্ঘটনা, আঘাত বা জখমের মধ্যে ফেলেছে। এগুলো হচ্ছে আত্মহত্যা, সড়ক দুর্ঘটনা, পড়ে যাওয়া, ধারালো বস্তু দ্বারা কেটে যাওয়া, পড়ন্ত বস্তুর আঘাতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
এ ছাড়া পুড়ে যাওয়া, প্রাণী ও কীটপতঙ্গের কামড় ও আঘাত, সহিংসতা, পানিতে ডোবা, মেশিন বা যন্ত্রপাতির আঘাত, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট, দুর্ঘটনাজনিত শ্বাসরোধ ও বিষপানে তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া ডেঙ্গুর পাশাপাশি অপরিণত বয়সের শিশুমৃত্যুর বিষয়টিও রয়েছে। আছে মাতৃমৃত্যুর মতো ঘটনাও।
চিকিৎসক সংকট প্রকট
বিভাগীয় স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্টদের মতে, বরিশাল বিভাগের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে জনসংখ্যার অনুপাতে চিকিৎসকের অনুমোদিত পদের সংখ্যা কম। এর মধ্যে যতগুলো পদ আছে, তার প্রায় ৪৬ শতাংশই দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। ফলে বিভাগের প্রায় এক কোটি মানুষের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন মাত্র ৬৮৮ জন চিকিৎসক। এত কম জনবল নিয়ে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হিমশিম খাচ্ছে।
ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা (২০২২ সাল) অনুযায়ী, বিভাগের জনসংখ্যা ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার ৭৭৯। স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ৬টি জেলা সদর হাসপাতালের পাশাপাশি ৪২টি উপজেলার মধ্যে ৪০টিতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসকের পদ আছে এক হাজার ২৮১টি। ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ওই পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ৬৮৮ জন। সেই হিসাবে স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসকের শূন্য পদ ৫৯৩টি।
যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) আদর্শ মান অনুযায়ী, প্রতি এক হাজার মানুষের স্বাস্থ্যসেবার জন্য একজন চিকিৎসক থাকতে হবে। সেই বিবেচনায় বরিশাল বিভাগে প্রতি সাত হাজার ১০৩ জন মানুষের জন্য সৃষ্ট পদের হিসেবে মাত্র একজন করে চিকিৎসকের পদ রয়েছে। আর শূন্য পদের হিসেবে ১৩ হাজার ২২৬ জনের জন্য আছেন মাত্র একজন চিকিৎসক কর্মরত আছেন। জনসংখ্যা অনুপাতে চিকিৎসকের এই চিত্র বলে দেয়, এই বিভাগে চিকিৎসাসেবার পরিস্থিতি কতটা বেহাল।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
শেবাচিম হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, ‘হাসপাতালটিতে ৫০০ শয্যার ২২৪ জনবলের চিকিৎসকের পদ রয়েছে। ওই পদের বিপরীতে ২০৫ জন চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন। তারা এক হাজার ৩০০ শিক্ষার্থীকে পাঠদানের পাশাপাশি সেবাপ্রার্থীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। হাসপাতালটিতে চিকিৎসক সংকটের পাশাপাশি আধুনিক যন্ত্রপাতিরও সংকট বিদ্যমান।’
তিনি আরো বলেন, ‘জেলা ও উপজেলা পর্যায় থেকে মুমূর্ষু রোগীরা এখানে ভর্তি হন। তাদের একটা অংশই মারা যায়। প্রতিটি ওয়ার্ডে সেই তথ্য রয়েছে। তবে প্রতি মাসের তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে শুধু সংখ্যাই থাকে।’
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, ‘ছয় জেলায় সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৩৮২টি। এর মধ্যে ছয়টি জেনারেল হাসপাতাল, ৪০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৭০টি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ২৬৬টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এসব হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ এক হাজার ২৮১টি। সেখানে প্রায় অর্ধেক চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন। যাদের অনেকেই আবার ডেপুটেশনে রয়েছেন। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের।’