মঙ্গলবার, ০১:৪৯ পূর্বাহ্ন, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২রা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

শেখ পরিবারের কোটায় বরিশালের মেয়র: আট মাসেই শতকোটি টাকা হাতিয়েছেন খোকন

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক:
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ২১ আগস্ট, ২০২৪
  • ২৩ বার পঠিত

গত বছরের এপ্রিলের আগে বরিশালের কেউ চিনত না খোকন সেরনিয়াবাতকে। বরিশাল সিটি করপোরেশন (বিসিসি) নির্বাচনে কে পাবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন তা নিয়ে যখন চলছিল আলোচনা-হঠাৎ করে নৌকার মাঝি হিসাবে কেন্দ্র থেকে ঘোষিত হয় তার নাম।

অনেকটাই হতবাক হয়ে পড়েন বরিশালের মানুষ। কে এই খোকন সেরনিয়াবাত তা জানতে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন সবাই। পরে জানা যায়, দলের প্রভাবশালী নেতা আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর একমাত্র ভাই ও শহিদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ছোট ছেলে এই খোকন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই।

দলীয় রাজনীতিতে কোনো অবদান না থাকলেও শেখ পরিবারের কোটায় ওই বছরের ১২ জুন অনুষ্ঠিত প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে জয়ী হন খোকন। মেয়রের দায়িত্ব নেন ১৪ নভেম্বর। মাত্র সাড়ে ৮ মাস ছিলেন এ দায়িত্বে। এ সময়েই নগর ভবনের ঠিকাদারির পার্সেন্টেজ নেওয়াসহ বিভিন্ন উপায়ে প্রায় শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনার ভাই হিসাবে প্রশাসনসহ সর্বস্তরের মানুষকে তটস্থ করে রেখেছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত তার কথায় উঠতে আর বসতে হতো বরিশালের প্রায় সবাইকে।

দায়িত্ব নেওয়ার পর সাবেক মেয়র তারই ভাতিজা সাদিক আব্দুল্লাহর সময়ে বরাদ্দ দেওয়া নগরীর ১৮টি হাটবাজারের ইজারা বাতিল করেন খোকন। তার লোকজন দখল করে নেয় নগরীর দুটি বাস টার্মিনালসহ সব লঞ্চঘাট ও বালুমহালসহ অন্যান্য স্থাপনা। সেখান থেকে আয় হওয়া অর্থের ভাগ নিতে শুরু করেন তিনি।

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে নগর ভবনের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার পরও টানা ৮ মাস বন্ধ রাখা হয় বরিশাল নগরীর সব প্রকার ভবন এবং স্থাপনা নির্মাণের প্ল্যান অনুমোদন। পরে ১-২টা করে প্ল্যান ছাড়া শুরু হলেও ৬ তলার বেশি উচ্চতার ভবনের প্ল্যান অনুমোদনের ক্ষমতা নিজের হাতে রেখে দেন খোকন। কি কারণে তিনি এটা নিজের হাতে রেখেছেন তা সহজেই অনুমেয়। ৬ তলার নিচের ভবনের প্ল্যান অনুমোদনেও নির্দিষ্ট অঙ্কের উৎকোচ দিতে হতো তার নির্ধারিত লোককে।

নির্বাচনের সময় সব প্রকার অযৌক্তিক কর বাতিলের ঘোষণা দিলেও দায়িত্ব নেওয়ার পর সেগুলো প্রত্যাহার তো দূর, বরঞ্চ নতুন করে পানির লাইন স্থাপনসহ বিভিন্ন খাতে কর বাড়ান খোকন। ট্রেড লাইসেন্স, সাইন বোর্ড রাজস্বসহ প্রায় সব খাতে টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে দেন তিনি। ফলে বাড়তি করের কবলে পড়েন নগরবাসী। এমনকি ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরও অজ্ঞাত স্থান থেকে ২৮ জুলাই প্রায় ২ কোটি টাকার চেক স্বাক্ষর করেন খোকন।

কোভিড প্রকল্পের ওই টাকা অতি সম্প্রতি এসেছিল নগর ভবনে। ২ কোটি টাকার চেক ছাড়ার বিনিময়ে পার্সেন্টেজ বাবদ টাকা নেন ২০ লাখ।’ চলতি বছরের মার্চে বরিশাল নগরীর বিভিন্ন সড়ক ও ড্রেন নির্মাণ এবং সংস্কার কাজের ২৬৭ কোটি টাকার টেন্ডার আহ্বান করে সিটি করপোরেশন। আগে ভাগেই ঠিক হয়ে থাকা ঠিকাদারদের কার্যাদেশ দেওয়া হয় পরের মাস এপ্রিলে।

১৮ গ্রুপের ওই কাজ পাওয়াদের তালিকায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বর্তমান উপদেষ্টা এএফ হাসান আরিফের শ্যালক বরিশালের বিতর্কিত ঠিকাদার মাহফুজ খানের নামও রয়েছে। ১৮ গ্রুপের কাজের মধ্যে তিনি একাই পান ৬ গ্রুপের কাজ। কাজ পাওয়া একাধিক ঠিকাদার যুগান্তরকে জানান, ‘টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগেই আমাদের সঙ্গে কাজের ব্যাপারে সবকিছু ফাইনাল করে নেন খোকন সেরনিয়াবাত। টেন্ডার মূল্যের বিপরীতে শতকরা ১০ ভাগ টাকা তাকে অগ্রিম দিয়ে কাজ নিতে হয় আমাদের।’

শুধু এই ২৬৭ কোটি টাকার ঠিকাদারিই নয়, গত সাড়ে ৮ মাসে নগর ভবনে যতগুলো ঠিকাদারি কাজের টেন্ডার কিংবা মৌখিক নির্দেশ হয়েছে, তার সবগুলোর ক্ষেত্রেই নির্ধারিত ১০ পার্সেন্ট হিসাবে টাকা দিতে হয়েছে খোকন সেরনিয়াবাতকে।

দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকেই আয় বাণিজ্যের খাতগুলোতে হাত দিতে শুরু করেন খোকন সেরনিয়াবাত। ভাগাভাগিতে বনিবনা না হওয়ায় নগরীর নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে সরিয়ে দেন বাস মালিক গ্রুপের তৎকালীন সভাপতি আফতাব হোসেনকে।

বসান নিজের লোক ছাত্রলীগের সাবেক নেতা অসীম দেওয়ানকে। এই অসীম দেওয়ান ছিলেন খোকনের আয় বাণিজ্যের ক্যাশিয়ার। নগর ভবনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বরিশাল নগরে বিসিসি’র নিয়ন্ত্রণাধীন মোট ১৮টি হাটবাজার রয়েছে।

সঠিক নিয়মে টেন্ডার হলে এসব হাটবাজার থেকে বছরে ২০ কোটি টাকা ইজারা মূল্য আয় করা সম্ভব। কিন্তু নিজের আয় ঠিক রাখতে মাত্র ১ কোটি টাকায় হাটবাজারগুলো নিজের লোকজনের মধ্যে বণ্টন করে দেন খোকন। বিনিময়ে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। এসব বাজার থেকে ওঠা প্রতিদিনের টাকার হিসাব নিতেন অসীম দেওয়ান। তারপর নির্ধারিত অঙ্ক পৌঁছে যেত সদ্য সাবেক মেয়রের বাসায়।’

বিআইডব্লিউটিএর একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পরপরই বরিশাল লঞ্চঘাটসহ নদী বন্দরে থাকা আমাদের প্রায় সব ঘাট দখল করে নেয় খোকন সেরনিয়াবাতের লোকজন। পরে অনেকটা বাধ্য হয়ে সরাসরি রাজস্ব আদায় দেখিয়ে তাদের হাতে ঘাট পরিচালনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হই আমরা।

চলতি বছরের জুনে হাসিবুল ইসলাম নামে একজন একতলা লঞ্চ ঘাটের ইজারা পেলেও তাকে ঘাট বুঝিয়ে দিতে পারিনি।’ বরিশাল স্পিডবোট ঘাটের একাধিক বোট চালক বলেন, ‘এই ঘাট থেকে খোকন সেরনিয়াবাতের নামে নিয়মিত ওঠানো হত মোটা অঙ্কের চাঁদা। না দিলে বোট চালাতে না দেয়ার হুমকি দিত।’

বরিশাল নগরের দুটি বাস টার্মিনাল থেকেও মাসে ২৫ থেকে ৩০ লাখ করে টাকা নিতেন খোকন সেরনিয়াবাত। বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিবার গাড়ি ছাড়ার বিপরীতে ৬০ টাকা করে আদায় করত তার লোকজন। এভাবে দুটি টার্মিনাল থেকে আয় হতো প্রায় ১৪ লাখ টাকা।

এ ছাড়া মালিক সমিতির নিয়ন্ত্রণে থাকা বিএমএফ পরিবহণের আয়ের টাকাও দিতে হতো থাকে। এই খাতেও মাসে ৬-৭ লাখ টাকা পেতেন তিনি। দূরপাল্লার নতুন কোনো পরিবহণ এলে বরিশালের ওপর দিয়ে চলার বিনিময়ে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা দিতে হতো খোকন সেরনিয়াবাতকে।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এমন কোনো খাত নেই যেখান থেকে টাকা দিতে হতো না তাকে। এমনকি সাবেক মেয়র মরহুম শওকত হোসেন হিরনসহ তার ঘনিষ্ঠদের মালিকানাধীন ‘বরিশাল প্ল্যানেট পার্ক’র চুক্তি নবায়নেও উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পার্কের পরিচালনা পরিষদের একজন বলেন, ‘নবায়ন প্রশ্নে করপোরেশনের ফি প্রায় ১০ লাখ টাকা ছাড়াও আলাদাভাবে ৪০ লাখ টাকা দিতে হয়েছে।’

এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য খোকন সেরনিয়াবাতের মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তার ব্যক্তিগত সহকারী মো. রুবেলের নম্বরে ফোন দিলে রিং হলেও তিনি তা ধরেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো উত্তর মেলেনি।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com