বৃহস্পতিবার, ০১:৫০ অপরাহ্ন, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

শুধু ডলারের ঘাটতিই কি রাষ্ট্রের দেউলিয়াত্বের কারণ

ড. মো: মিজানুর রহমান
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২
  • ১১২ বার পঠিত

কেন এবং কিভাবে একটি রাষ্ট্র দেউলিয়া হয় সে কথা বলার আগে দেউলিয়াত্ব কী এবং কেন সে বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন মনে করছি। ‘দেউলিয়াত্ব’ একটি আইনি প্রক্রিয়া যা একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি তার ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম হলে ঘোষিত হয়। সাধারণত, দেউলিয়াত্ব একটি ব্যবসায় বা ব্যক্তিকে পূর্ব ঋণ মওকুফ করে নতুন করে কার্যক্রম শুরু করার সুযোগ দেয়। এই প্রক্রিয়া একটি আবেদনের মাধ্যমে শুরু হয় যা পাওনাদার বা দেনাদার দায়ের করে। এই প্রক্রিয়ায় বকেয়া ঋণ পরিশোধে কী সাহায্য করতে পারে তা নির্ধারণ করার জন্য দেনাদারের সমস্ত সম্পদ মূল্যায়ন করা হয়।

পাওনাদারদের জন্য, এটি কিছু পরিশোধের ব্যবস্থা করার সুযোগ দেয়া যায় স্থাবর সম্পদ লিকুইডেশনলব্ধ অর্থ দিয়ে। দেউলিয়া হওয়ার জন্য ফাইল করা সামগ্রিকভাবে উপকারী, কারণ এতে ব্যক্তি অথবা কোম্পানি ক্রেডিট অ্যাক্সেস পাওয়ার জন্য দ্বিতীয় সুযোগ পাওয়ার যোগ্য হয়। একবার দেউলিয়া হওয়ার প্রক্রিয়া সফলভাবে সম্পন্ন হলে, দেনাদার ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি পায়।

ব্যক্তি অথবা করপোরেট ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানের মতো একটি রাষ্ট্রও দেউলিয়া হতে পারে ও হয়। একটি রাষ্ট্র তখনই দেউলিয়া হয় যখন তার সরকার নির্ধারিত সময়ে ঋণ ও অন্যান্য প্রদেয় বিল পরিশোধে ব্যর্থ হয়; যদিও ইন্ডিয়া টাইমস লিখেছে, যদি কোনো দেশ দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে বলা হয়, তাহলে সেটি ভুল বলা হবে। যখন কোনো দেশ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তখন তারা দেউলিয়া হয়ে যায় না; তারা ঋণখেলাপি হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- খেলাপি হয় সরকার, রাষ্ট্র নয়।

সাধারণত, কোনো দেশে সামরিক অভ্যুত্থান কিংবা গণবিপ্লব সংঘটিত হলে রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। কারণ এ অবস্থায় নতুন সরকার আগের সরকারের আর্থিক কর্মকাণ্ডের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বকেয়া ঋণ ও পাওনা পরিশোধের দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত করে রাষ্ট্রকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে পারে। ইতিহাসে বহু দেশই তাদের কোনো না কোনো সময়ে এমনকি একাধিকবার ঋণখেলাপি হয়েছে ও সেখান থেকে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

কোনো রাষ্ট্র যদি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে তবে রাষ্ট্রের কোনো সম্পত্তি নিলামে ওঠে না। এ ছাড়া দেশের অনেক সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও তারল্য সঙ্কটের কারণেও কোনো দেশ দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় দেউলিয়াত্বের আরেক কারণ হতে পারে, অসচ্ছলতা। এ ছাড়া আরো কিছু কারণে একটি দেশ দেউলিয়া হতে পারে। যেমন- ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকা, ঋণ পরিশোধে খরচ সাশ্রয়ের পদক্ষেপ না নেয়া, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি ইত্যাদি।

রাষ্ট্র দেউলিয়া হওয়ার ইদানীংকার উদাহরণ শ্রীলঙ্কা ও লেবানন হলেও কেবল এই দু’টি দেশই হয়েছে এমনটি কিন্তু নয়। পৃথিবীতে প্রথম দেশ হিসেবে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছিল প্রাচীন গ্রিস ৩৭৭ খ্রিষ্টাব্দে। গ্রিস ১৮২৯ সালে, এমনকি আজ থেকে প্রায় দুই হাজার ৪০০ বছর আগেও ঋণখেলাপি হয়েছিল। এদিকে মহামারী করোনার থাবায় নাকাল হয়ে ২০২১ সালে রাষ্ট্রের দেউলিয়াত্ব ঘোষণা করে ব্রাজিল। গত দুই দশকে ইউরোপের প্রায় অর্ধেক দেশ, আফ্রিকার ৪০ শতাংশ দেশ ও এশিয়ার প্রায় ৩০ শতাংশ দেশ নানা সময়ে দেউলিয়া হয়েছে।

এই তালিকায় কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও চীনও রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত মোট ১০ বার দেউলিয়া হয়ে সবচেয়ে বেশিবার এই সুযোগ নিয়েছে ইকুয়েডর। এমনকি ১৯৯০ ও ২০০১ সালে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে রাশিয়া। অন্যদিকে আঠারো থেকে উনিশ শতকের মধ্যে ১৫ বার ঋণ শোধে ব্যর্থ হয়ে সবচেয়ে বেশিবার ঋণখেলাপি হয় ইউরোপীয় দেশ স্পেন। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কা ও লেবানন তাদের দেশকে দেউলিয়া ঘোষণা দিয়েছে এবং একই পথে হাঁটছে নেপাল ও পাকিস্তান। চীনা ঋণ নিয়ে দেউলিয়াপনার মহা-আতঙ্কে আছে আরো অনেক দেশ।

আগেই বলেছি, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দেউলিয়াত্ব আর রাষ্ট্রকে দেউলিয়া ঘোষণা এক বিষয় নয়। কোম্পানি দেউলিয়া হলে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ করতে পারে আন্তর্জাতিক আদালত। রাষ্ট্র দেউলিয়া হলে সেই এখতিয়ার নেই আদালতের। প্রশ্ন হচ্ছে- একটি দেশ দেউলিয়াত্বের কলঙ্ক কিভাবে লেপন করে ঘুরে দাঁড়াতে পারে? এ জন্য প্রথমত দেশটিকে তার অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে হয়। দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে হয় ও সম্পূর্ণ স্বনির্ভর হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে হয়।

যখন একটি দেশ দেউলিয়া হয়ে যায় তখন দেশটিতে দেখা দেয় তীব্র বেকারত্ব ও খাদ্যসঙ্কট। রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা দেয়ার মতো অর্থ তাদের ভাণ্ডারে থাকে না। বিদেশে দেশটির বিরাট অঙ্কের ঋণ থাকলে সেই ঋণের জন্য প্রতি মাসে যেভাবে সুদ পরিশোধ করতে হয় তা তারা করতে পারে না। এ ছাড়া জাতীয় জীবনের কল্যাণের জন্য যেসব অর্থবিত্ত দরকার তা-ও থাকে না দেশটির।
ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও খাদ্যসঙ্কটে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম হয়ে যায় আকাশছোঁয়া। বৈদেশিক ঋণ আর দুর্নীতির কারণে বর্তমানে শ্রীলঙ্কায়ও অনেকটা এরকম ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে দেশটিকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়।

এখন আমরা দেখব, এক সময়ের সমৃদ্ধিশালী দেশগুলো কেনই বা দেউলিয়া হয় ও কিভাবে উত্তরণ ঘটায়। সাধারণত আদর্শ বিশ্বে, সরকারগুলো তাদের কর আর বিনিয়োগ থেকে যা আয় করে, তাই তারা ব্যয় আর দায় মেটাতে খরচ করে। আবার যখন আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়ে গেছে ধার করতে হয়; সরকারও ঠিক তাই করে।

সরকার দু’ভাবে ঋণ করে। বন্ড ছেড়ে দেশের নাগরিকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে, যেখানে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে নির্দিষ্ট হারে সুদ দেয়ার প্রতিশ্রুতি থাকে। আবার বিদেশ থেকেও সরকার দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিতে পারে ও বিদেশী মুদ্রায় বন্ড ছেড়ে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। সরকারের এই ঋণকে বলা হয় ‘সার্বভৌম ঋণ’।

দেশের ভেতরের ঋণ দেশীয় মুদ্রায় শোধ করা যায়; সরকার কর বাড়িয়ে, সুদের হার কমিয়ে, কিংবা ঠেকায় পড়লে নতুন টাকা ছাপিয়ে সেই ঋণ সামাল দিতে পারে। কিন্তু বিদেশী ঋণ শোধ করতে হয় বিদেশী মুদ্রায়। ফলে দরকার হলে আয়বর্ধক বিনিয়োগের খাত থেকে ডলার সরিয়ে সেই ঋণ শোধ করতে হয়। পরিস্থিতি তখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে না।

সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের একসময়ের সমৃদ্ধ দেশ লেবাননকে দেউলিয়া ঘোষণার কারণ বলতে গেলে দেশটির ইসরাইল বিরোধিতার ফলে দেশটিকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে অস্থির করে তুলতে পশ্চিমারা একের পর এক প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। ফলে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সমৃদ্ধ লেবানন। ফলে চলতি বছরের ৪ এপ্রিল লেবাননের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে এই রাষ্ট্রটিও দেউলিয়া হয়ে যায়; যদিও উপপ্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্ষতি যেহেতু হয়েই গেছে, আমরা চেষ্টা করব জনগণের ওপর থেকে এই ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে আনতে। যে ক্ষতি হয়েছে তা রাষ্ট্র ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক এবং আমানতকারীরা ভাগ করে নেবেন। সবশেষে তিনি বলেন, আশা করি, সব কিছুই একদিন স্বাভাবিক হবে। সঙ্কটের কারণে বিদেশী মুদ্রায় অর্থ উত্তোলন দেশটিতে ২০১৯ সাল থেকেই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিল।

উল্লেখ্য, লেবানন ২০১৯ সালের শেষ দিক থেকে মারাত্মক অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলা করছে। মুদ্রার মান কমে যাওয়া ছাড়াও তেল ও চিকিৎসাসরঞ্জাম নিয়ে সঙ্কটের মধ্যে আছে দেশটি। মুদ্রার মান ৯০ শতাংশ পর্যন্ত পড়ে যাওয়ার ফলে খাদ্য, পানি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদাগুলোর ঘাটতি দেখা দেয়। জনরোষ বাড়তে থাকলে এক পর্যায়ে রাস্তায় নেমে আসে মানুষ। জ্বালানি সঙ্কটে বিদ্যুৎ সরবরাহেও ধস নেমেছিল।

এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কায়ও দেখা দিয়েছে ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সঙ্কট। এ অবস্থায় স্বর্ণদ্বীপখ্যাত শ্রীলঙ্কা নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। একতরফাভাবেই বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ স্থগিত ঘোষণা করেছে শিক্ষা ও মাথাপিছু আয়ে এশিয়ার একসময়ের শীর্ষ দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থনৈতিক সঙ্কটে ধুঁকতে থাকা শ্রীলঙ্কা সরকার সব বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধ সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করেছে; যদিও দেশটির অর্থ সচিব বলেছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সহায়তা পেলে বিদেশী ঋণ পুনর্গঠনের মাধ্যমে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে।

উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিদেশী ঋণ পরিশোধে শ্রীলঙ্কার সুনাম ছিল। কিন্তু, কোভিড-১৯ মহামারীর দুই বছরের ধাক্কার পর ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে দুর্দশার পথে নিয়ে এসেছে। এ পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বেশি দরকার বিদেশী মুদ্রা। আর সে জন্য দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাকের গভর্নর এই ক্রান্তিকালে প্রবাসী লঙ্কানদের আরো বেশি করে বিদেশী মুদ্রা পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

দেউলিয়া ঘোষণার আগে, ভাণ্ডারে বিদেশী মুদ্রার মজুদ ফুরিয়ে যাচ্ছিল; বাজারে খাবারসহ নিত্যপণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছিল। জ্বালানি ও বিদ্যুৎসঙ্কটে অর্থনীতির চাকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আর্থিক সঙ্কটে থেকে শ্রীলঙ্কা সব মিলিয়ে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের দুয়ারে পৌঁছেছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্রীলঙ্কার এই বিপর্যয়ের প্রধান কারণ অপ্রয়োজনীয় বড় প্রকল্পে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি। আর তা করতে গিয়ে বিদেশী ঋণ গেছে বেড়ে। ঋণ বাড়ায় কিস্তি বাবদ নিয়মিত দায়ের অঙ্কও বেড়ে গিয়েছিল।

২০২২ সালে শ্রীলঙ্কাকে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার বিদেশী ঋণ শোধ করতে হবে, অথচ বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে মাত্র ১৫ কোটি ডলার, যা তাদের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। এ ছাড়া ২০২৩ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে শ্রীলঙ্কাকে আরো আড়াই হাজার কোটি ডলারের বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতে হতো। এর মধ্যে এসেছে দীর্ঘ মহামারী। দেশের বড় আয়ের উৎস যে পর্যটন খাত, সেখানে রীতিমতো খাখাশূন্যতা।

ফলে জনগণকে ‘ঠাণ্ডা’ রাখতে কর কমিয়ে আনা হয়েছিল, তাতেও কমেছিল সরকারের আয়। আন্তর্জাতিক ঋণ আর দেশের ভেতরে সরকারের দায় মেটাতে শ্রীলঙ্কা নতুন টাকা ছাপাচ্ছিল যা মূল্যস্ফীতির আগুনে ঘি ঢেলেছিল। ভয়ের কথা হলো- দেউলিয়া ঘোষণার আগে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির যে গতিধারা ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিধারায় তেমনি মিল পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে সরকারব্যবস্থা, লাগামহীন দ্রব্যমূল্য, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত কমে যাওয়াসহ দেশী-বিদেশী ঋণের প্রবাহ, বিশেষ করে মেগা প্রজেক্ট-মেগা ঋণ যেন সেদিকে নিয়ে যাচ্ছে দেশটিকে; সতর্ক হতে হবে এবং তা এখনই।

উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, মূলত ঋণ নেয়ার পর তা কাজে লাগানোর অদক্ষতা বা খামখেয়ালি পদক্ষেপ সেই দেশকে খেলাপি হওয়ার পথে নিয়ে যায়। যখন একটি দেশের সরকার পরিবর্তন হয়, নতুন সরকার প্রায় ক্ষেত্রেই খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে আগের সরকারের করা ঋণের বোঝা কাঁধে চেপে যাওয়ায়। তখন তাদের ঋণ পুনর্গঠনের পথে হাঁটতে হয়। আন্তর্জাতিক তারল্য প্রবাহের স্রোত বদলে গেলে কিংবা রাজস্ব আদায় কোনো কারণে বিঘ্নিত হলেও সরকারের তহবিলে টান পড়ে।

অধিকন্তু, বিদেশী বাজারগুলো কোনো দেশের মুদ্রার ওপর আস্থা হারালে ও সেই দেশ সার্বভৌম ঋণ সঙ্কটে থাকলে সামগ্রিক পরিস্থিতি তাদের আর্থিক ও মুদ্রা সঙ্কটের দিকে নিয়ে যেতে পারে। ঋণখেলাপি দেশের জন্য আরেকটি বিপদ হলো- আন্তর্জাতিক বাজারে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। নতুন করে ঋণ নিতে গেলে তাদের জন্য চড়া সুদ ধার্য হয়। খেলাপি দেশের ক্রেডিট রেটিং কমে যায়, যা সে দেশে বিদেশী বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে।

পরিশেষে বলতে হয়, রাষ্ট্র দেউলিয়া হওয়ার নানাবিধ কারণ থাকলেও চূড়ান্তভাবে, ঋণ শোধ করতে না পারাই দেউলিয়া হওয়ার মূল কারণ। এ ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ঋণ বিভিন্নভাবে শোধ করা যায়। এমনকি কোনো পথ না থাকলে টাকা ছাপিয়েও শোধ করা যায়, যদিও তাতে মুদ্রাস্ফীতি মারাত্মকভাবে বেড়ে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু, বিদেশী ঋণ বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয় যা অর্জন করতে হয়।
আর বৈদেশিক মুদ্রা তো এখন শুধুই ডলার, সুতরাং ডলার ছাড়া ঋণ শোধ করা যায় না; যার অর্থ দাঁড়ায়- কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ যত সম্পদই থাকুক না কেন, কেবল ডলার না থাকলে আমদানি বন্ধ, তেল-গ্যাস বন্ধ, খাদ্য আমদানি বন্ধ, উন্নয়ন বন্ধ, আগের ঋণ পরিশোধ বন্ধ, চলতি ঋণের কিস্তি বন্ধ, নতুন ঋণ প্রাপ্তি বন্ধ; ফলে রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও গবেষক

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com