পবিত্র হজ উপলক্ষে আজ সৌদি আরবের পবিত্র নগরী মক্কার ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে আরাফাতের ময়দানে সমবেত হয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লাখ লাখ মানুষ। আজ মঙ্গলবার (২৭ জুন) সকাল থেকে কণ্ঠে তাঁদের সমস্বরে উচ্চারিত হচ্ছে—‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা, ওয়ান্নি মাতা লাকা ওয়াল্মুল্ক্, লা শারিকা লাকা’। এর বাংলা অর্থ ‘আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার’।
সেলাইবিহীন সাদা দুই টুকরা কাপড়ে শরীর ঢেকে হজযাত্রীরা আজ মঙ্গলবার মিনায় ফজরের নামাজ আদায়ের পর থেকেই পবিত্র আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে রওনা দেন। এই আরাফাতের ময়দানেই মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। এই দিনে হজযাত্রীরা নামাজ পড়ার জন্য আরাফাত ময়দানে ভিড় করেন। আজ আরাফাত ময়দানের নামিরাহ মসজিদ থেকে হজের খুতবা পাঠ করবেন ড. ইউসুফ বিন মুহাম্মদ বিন সাঈদ।
মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, এই আরাফাত ময়দানে হজরত আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-কে পৃথিবীতে ফেরত পাঠানোর পরে তারা আবার মিলিত হয়েছিলেন। তাছাড়া এখানেই মহানবি হজরত মোহাম্মদ (সা.) তাঁর বিদায়ী ভাষণ দিয়েছিলেন। মুসলমানরা আরাফাতের দিনে রোজা রাখতে পছন্দ করেন, কারণ এতে আগের বছর ও পরবর্তী বছরের সব পাপ মুছে ফেলার সুযোগ বলে বিশ্বাস করেন তারা।
আজ মঙ্গলবার হাজিরা আরাফাতের ময়দানে একত্রিত হন। এই পবিত্র স্থানে আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও রহমত চেয়ে দুআ (প্রার্থনা) করছেন তারা। এছাড়া আরাফাতের ময়দানে অবস্থানকালে হজযাত্রীরা নামিরাহ মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করবেন তারা। বিশ্বের লাখ লাখ হজযাত্রী সম্মিলিতভাবে আল্লাহর উপাসনায় নিজেদের নিমগ্ন রাখবেন। আজ সন্ধ্যায় হজযাত্রীরা মুজদালিফায় যাত্রা শুরু করবেন। এটি আরাফাত ও মিনার মধ্যে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। হজযাত্রীরা মুজদালিফায় রাত কাটাবেন এবং ছোট পাথর সংগ্রহ করবেন। মিনায় জামারাত স্তম্ভে শয়তানকে লক্ষ্য করে এসব পাথর নিক্ষেপ করবেন তারা।
জামারাত আল-আকাবায় পাথর নিক্ষেপ করার পর হজযাত্রীরা পশু কোরবানি করবেন। এরপর তাওয়াফ আল-ইফাদাহ বা ফরজ তাওয়াফ করার জন্য মসজিদুল হারামে যাবেন। এই তাওয়াফ অবশ্য ১০ থেকে ১২ জিলহজের মধ্যে যেকোনো সময় করতে পারবেন তারা। এ সময় তারা কাবা শরিফ তাওয়াফ ও সাফা-মারওয়া সাঈ করবেন এবং মাথা মুণ্ডন করবেন। একবার এই পবিত্র কাজটি সম্পন্ন করার পর হজযাত্রীদের আর ইহরামের নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে হবে না। তারা সব হালাল (অনুমতিযোগ্য) কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হতে পারবেন।
হজের অবশিষ্ট আচারগুলো সম্পন্ন করতে হজযাত্রীদের অবশ্যই আবার মিনায় ফিরে যেতে হবে। তাশরীকের দিনগুলোতে ১১, ১২ ও ১৩ জিলহজ হজযাত্রীদের মিনায় আরও দুটি কাজ করতে হবে। ১১ জিলহজ বিকেলে হজযাত্রীরা ২১টি ছোট পাথর সংগ্রহ করে তিন জামারাতে নিক্ষেপ করবেন। পাথর নিক্ষেপ শুরু হয় জামারাত আল-উলা, তারপর জামারাত আল-উস্তা এবং পরে জামারাত আল-আকাবা দিয়ে শেষ হয়।
মক্কা থেকে যাত্রা করার আগে হজযাত্রীদের তাওয়াফ আল-বিদা করতে হবে, যা বিদায়ী তাওয়াফ নামেও পরিচিত। এটি হজ সম্পন্ন করায় অত্যন্ত তাৎপর্য বহন করে এবং সব হজযাত্রীদের জন্য বাধ্যতামূলক।
মক্কায় বার্ষিক হজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় গত রোববার (২৫ জুন)। হজের সময়, সারা বিশ্ব থেকে লাখ লাখ মুসলমান মক্কায় জড়ো হন, শারীরিক ও অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম সবার ওপর এটি বাধ্যতামূলক। গত রোববার আগমনী তাওয়াফা শেষ করে গতকাল সোমবার মিনায় মক্কা থেকে পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে মিনায় তাঁবুতে অবস্থান করেন হজযাত্রীরা। সেখানে ইবাদত বন্দেগিতে দিন ও রাত পার করেছেন তারা। সেখান থেকে আজ মঙ্গলবার ভোরে তাঁরা আল্লাহকে কাছে পাওয়ার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষায় ছুটে যান আরাফাতের ময়দানে।
এই মাসের শুরুর দিকে সৌদি আরবের কর্মকর্তারা জানান, লাখ লাখ হজযাত্রীদের সাহায্য করার জন্য ১৪ হাজারের কর্মী ও আট হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত থাকবে।
দুটি পবিত্র মসজিদ (মসজিদুল হারাম ও মসজিদুল নববী) বিষয়ক জেনারেল প্রেসিডেন্সি ৩০ হাজারের বেশি বিতরণ পয়েন্টের মাধ্যমে চার কোটি লিটার জমজম পানি বিতরণ করবে, যা প্রতিদিন হজযাত্রীদের কমপক্ষে ২০ লাখ বোতল সরবরাহ করবে।
মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদ (মসজিদুল হারাম) এবং মদিনার মসজিদে নববীতে মোট তিন লাখ কপি কোরআন বিতরণ করা হবে। এছাড়া হজযাত্রীরা কোরআন তেলাওয়াত ও হিফজ কর্মশালায় অংশ নিতে পারবেন।
সৌদি আরবের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ আল-আব্দুলালী বলেন, ছয় হাজার শয্যা ধারণক্ষমতার ৩২টির বেশি হাসপাতাল হজযাত্রীদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে প্রস্তুত রয়েছে।
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ২০১৯ সালের পর এবারের হজে সবচেয়ে বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করছে। ২০১৯ সালে আনুমানিক ২৫ লাখ মানুষ হজে অংশ নিয়েছিলেন। বিশ্বব্যাপী করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে ২০২০ সালে মাত্র ১০ হাজার ব্যক্তিকে হজে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ২০২১ সালে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৫৯ হাজার। সৌদি কর্তৃপক্ষের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২২ সালে মোট আট লাখ ৯৯ হাজার ৩৫৩ জন হজ করতে পেরেছিলেন। সৌদির হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় জানায়, এ বছর ২০ লাখ হজযাত্রীকে স্বাগত জানানো হচ্ছে।