মিয়ানমার থেকে ২০১৭ সালে যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি ব্যাপকভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ শুরু করে, তার পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। অথচ রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে কবে ফিরে যাবে, সে কথা কেউই বলতে পারছে না। এনিয়ে যে আলোচনা চলছিল সেটিও এখন থমকে গেছে বলেই মনে হচ্ছে।
নিজ দেশে ফেরা অনিশ্চিত জেনেই অনেক রোহিঙ্গা এখানেই নিজেদের ভাগ্য অন্বেষণে ব্যস্ত।
বৈধভাবে কাজের সুযোগ না থাকলেও জীবনের তাগিদে রোহিঙ্গারা জীবিকা খুঁজে নিচ্ছেন।
ক্যাম্পের বাইরে একটি দোকানে মাসে আট হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন মোহাম্মদ রফিক। তিনি বলছেন, এখানে ভালোই আছেন, তবু নিজ দেশে ফিরে যেতে চান।
নূর মোস্তফা ১৩ বছর বয়সে পরিবারের সাথে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে উখিয়ায় এসে আশ্রয় নিয়েছে।
এই ক্যাম্পের ভেতরেই কৈশোর পেরিয়ে এখন প্রাপ্ত বয়স্ক তিনি।
পালিয়ে বাংলাদেশে আসার ব্যাপারটিকে তিনি সাময়িক মনে করেছিলেন।
ভেবেছিলেন হয়তো কয়েক মাস কিংবা বেশি হলে বছর খানেক হয়তো এখানে থাকতে হতে পারে। কিন্তু এতোটা সময় পার হয়ে যাবে তিনি সেটা ভাবতেই পারেননি।
‘আমরা চলে যেতে চাই। কয় বছর লাগবে সেটা কিভাবে বলবো? যদি আল্লাহর হুকুম হয় এবং বিভিন্ন রাষ্ট্র মিলে ওদের উপর চাপ দিয়ে সমস্যার সমাধান করে দেয়, তাহলে আমরা চলে যাব,’ বলেন নূর মোস্তফা।
তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করেছিলাম, একমাস-দুই মাস লাগবে কিংবা বছর দুই বছর লাগতে পারে। আমরা ভেবেছিলাম মিয়ানমার সরকার আমাদের মেনে নেবে এবং ডেকে নিয়ে যাবে। আমরা যেটা চাই সেটা দিলে চলে যাব।’
এখন থেকে পাঁচ বছর আগে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর দ্বারা হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ থেকে বাঁচতে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয় প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা।
এরপর থেকে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য কয়েক দফা উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবার ব্যাপারে মিয়ানমার সরকার যেমন সহযোগিতা করেনি তেমনি রোহিঙ্গারাও আগ্রহ দেখায়নি।
মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার কথা উঠতেই উদ্বেগ প্রকাশ করেন নূর বেগম।
বলেন, ‘বার্মার কথা বললেই বেশি ভয় লাগে। ওখানে এতো কাটাকাটি। কিভাবে ফিরে যাব? দেশ যদি ভালো হতো, তাহলে ফিরে যেতাম।’
বাংলাদেশ-মিয়ানমার ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। পরে জাতিসঙ্ঘও সেই চুক্তিতে যুক্ত হয়েছিল।
চুক্তিতে বলা আছে, রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ফেরত না গেলে তাদের জোর করে ফেরত পাঠানো যাবে না।
রোহিঙ্গারা বলছেন যে, পরিস্থিতিতে তারা পালিয়ে এসেছিলেন সে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। সহসা প্রত্যাবাসন হচ্ছে না বলে অনেকেই ধরে নিয়েছে।
রোহিঙ্গারা যাতে অবাধে চলাফেরা করতে না পারে সেজন্য ক্যাম্প ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও ক্যাম্প কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য খুব একটা সফল হচ্ছে না। রোহিঙ্গারা অনায়াসে ক্যাম্প থেকে আসা-যাওয়া করছে।
উখিয়ার বিভিন্ন জায়গায় গেলে কে রোহিঙ্গা আর কে বাঙালি সেটা বোঝা খুবই কঠিন।
এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে ২০২১ সাল থেকে ভাসান চরে স্থানান্তরের কাজ শুরু হয়।
নোয়াখালীর ভাসান চরে এক লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে স্থানান্তরের জন্য অবকাঠামো নির্মাণ করে বাংলাদেশ।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিচালনা এবং প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত কক্সবাজারে অবস্থিত বাংলাদেশের শরণার্থী, ত্রাণ এবং প্রত্যাবাসন কমিশনারের অফিস। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দ্রুত করা এবং উখিয়া টেকনাফে বাংলাদেশীদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সংগঠন গড়ে উঠেছে।
তারা বলছেন, প্রত্যাবাসনের কোনো লক্ষণ তো নেই বরং রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ে সরকার যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেগুলোও বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
এদের মধ্যে রবিউল ইসলাম একটি সংগঠনের সাথে জড়িত।
বলেন, ‘আমরা চাই যতদিন প্রত্যাবাসন না হয়, ততদিন রোহিঙ্গারা কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে থাকুক। কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় ক্যাম্পের জীবনে রোহিঙ্গাদের আর আটকে রাখা যাচ্ছে না। নানাভাবে অনেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিনিয়তই দেশের নানা প্রান্ত থেকে রোহিঙ্গাদের আটক করছে।
সূত্র : বিবিসি