হজের পর বিশ্বে মুসলিমদের সবচেয়ে বড় জমায়েতটি হয় বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমায়। ইজতেমায় অংশ নিতে প্রতি বছর অন্তত ১০ থেকে ১৫ হাজার বিদেশী নাগরিক বাংলাদেশে আসেন। যাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যারা বহু বছর ধরে নিয়মিত শুধু ইজতেমার জন্যই বাংলাদেশে আসছেন।
ইজতেমার দ্বিতীয় দফায় এবার ৭০টির বেশি দেশ থেকে প্রায় সাড়ে আট হাজার বিদেশী নাগরিক ইজতেমায় অংশ নিতে এসেছেন। এদের মধ্যে মধ্য এশিয়া বা আফ্রিকার মুসলিম দেশের নাগরিকদের পাশাপাশি ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্য আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার মুসলিমরাও রয়েছেন।
এদের একজন দক্ষিণ আফ্রিকান ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শেখ ইসমাইল নুরানি, যিনি গত ৪৭ বছর ধরে ইজতেমার জন্য বাংলাদেশে আসছেন। ৬৯ বছর বয়সী এই দক্ষিণ আফ্রিকানের কাছে জানতে চাওয়া হয় কেন তিনি গত ৪৭ বছর ধরে বাংলাদেশে ইজতেমায় আসছেন?
তিনি বলেন, ‘ব্যবসার কাজে আমি ইউরোপ, আমেরিকায় হিলটন, ম্যারিয়টের মতো অনেক ফাইভ স্টার হোটেলে থেকেছি। কিন্তু এখানে যে সুযোগ-সুবিধা আর সেবা পাই তার সাথে কিছুর তুলনা হয় না।’
নুরানির রুমে বসেই তার সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের।
ইজতেমায় বিদেশী অতিথিদের থাকার জন্য টঙ্গিতে তৈরি করা হয় তিন তলা ভবন। এর এক তলার সেই কামরাটি একেবারেই সাদামাটা একটি কক্ষ।
তাই হিলটন ম্যারিয়টের মতো বিখ্যাত ফাইভ স্টার হোটেলের সাথে তুলনা দেয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আমার বিস্ময় ছিল নিখাঁদ। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন তিনি, ‘পৃথিবীর আর কোথায় চার-পাঁচ দিন তিন বেলা বিশ্বের সেরা খাবারগুলো পাওয়া যায়?
গরম পানি, কাপড় ধোয়ার সার্ভিস, ইবাদত করার সুবিধা পাওয়া যায় পূর্ণ নিরাপত্তায়? এবং এই সব কিছু সম্পূর্ণ বিনা খরচে?’
শুধু বিনা খরচে খাওয়া-দাওয়া, নিরাপত্তা আর অন্যান্য সুযোগ সুবিধার জন্য নয়, আয়োজকদের ব্যবস্থাপনা আর মানুষের আতিথেয়তাও বারবার ইজতেমায় আসার পেছনে বড় কারণ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি আরো জানান, ইজতেমার জন্য ১৯৭৬ সালে প্রথমবার বাংলাদেশে আসেন তিনি। সে সময় তার বয়স ছিল ২২ বছর। তিনি বলছিলেন, ‘প্রথমবার বাংলাদেশে আসার আগে আমরা শুনেছি যে এটি তৃতীয় বিশ্বের দেশ। এই দেশে ব্যাপক মাত্রায় অপুষ্টি, দারিদ্র আর অশিক্ষা। কিন্তু আল্লাহর মেহমানদের জন্য এই দেশের মানুষের ভালোবাসা দেখে মনে হয়েছে যে ইজতেমার জন্য এর চেয়ে আদর্শ জায়গা আর হতে পারে না।’
গত ৪৭ বছরের মধ্যে অন্তত ৪০ বছর ইজতেমার জন্য বাংলাদেশে এসেছেন বলে জানান এই দক্ষিণ আফ্রিকান। যে তিন তলা ভবনে বসে তার সাথে কথা হচ্ছিল, নুরানি স্মৃতিচারণ করছিলেন, ১৯৭৬ সালে সেটি টিনের ছাউনি দেয়া একটি থাকার জায়গা ছিল।
নুরানি বলছিলেন, ‘তখন আমেরিকা আর রাশিয়ার মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। পরিস্থিতিটা এমন ছিল যে, পৃথিবীর কোনো শক্তি তাদের এক করতে পারবে না।
কিন্তু সেবার ইজতেমার প্রথমদিন আমি যখন খেতে বসি, তখন আমার সাথে একই প্লেটে একজন আমেরিকান ডাক্তার আর দু’জন রাশিয়ানও খেতে বসেন।’
‘সে সময় আমার মনে হয়েছিল যে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র এক দেশে যেই ঘটনাটি ঘটছে- পৃথিবীর আর কোথাও কি এখন এমন কিছু হওয়া সম্ভব?’ বলেন তিনি।
তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশটি কিভাবে বিনা খরচে ইজতেমার হাজার হাজার বিদেশী অতিথিদের সেবা করে যাচ্ছে, কথার ফাঁকে ফাঁকে এ নিয়ে বারবার বিস্ময় প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন তিনি।
ইজতেমার আয়োজক ও ব্যবস্থাপকরা অতিথিদের ক্ষুদ্র চাহিদার দিকেও নজর রাখেন বলে বলছিলেন নুরানি। ‘বাংলাদেশে আসার প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে আসার পর ছোট ছোট বিষয় কতটা আন্তরিকতার সাথে যে দেখভাল করা হয়, এবং সেগুলো যে কিভাবে সম্পন্ন করা হয়, তা এক আশ্চর্যের বিষয়।
অতিথিদের প্রতিটি প্রয়োজনের দিকে নজর রাখা হয়। কেউ না কেউ সার্বক্ষণিক খোঁজ নিতে থাকে কার, কখন, কী প্রয়োজন।’
‘আর খাবারের বিষয়ে আর কত বলবো। মালয়েশিয়ানদের জন্য মালয়েশিয়ান খাবার, আরবদের জন্য আলাদা খাবার, কেউ ঝাল বা পনিরযুক্ত খাবার খেতে চাইলে তার জন্য আলাদা ব্যবস্থা। কয়েক ধরনের রুটি, রাইস, বিভিন্ন ধরনের গোশত – কী নেই খাবারের মেনুতে। আর চা, কফি, ফল, জুস, স্ন্যাকস তো ২৪ ঘণ্টা ধরেই চলছে।’
ইজতেমায় বিদেশীদের অংশগ্রহণের সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয় স্বেচ্ছাসেবকদের আলাদা আলাদা দলের ওপর। বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা ও বয়সের মানুষ নিয়ে গড়া এই দলগুলোর সদস্যরা ইজতেমার সময়ে পাঁচ-ছয়দিন ধরে এই দায়িত্ব পালন করেন কোনো ধরনের পারিশ্রমিক ছাড়া।
‘আমি যখন দেশে ফেরত যাই তখন সেখানকার ভাইদের বলি যে, পৃথিবীর আর কোথায় তুমি এরকম দেশ পাবে যেখানে প্রতি বছর চার-পাঁচ দিনের জন্য ১৫-২০ হাজার বিদেশী অতিথিকে বিনা খরচে এমন সেবা দেয়া হয়’ বলছিলেন নুরানি।
ইজতেমায় আসার আগে প্রতিবার তিনি অন্তত সাতদিন সৌদি আরবে পবিত্র মক্কা ও মদিনা সফর করে আসেন। নুরানির মতো অনেকেই আছেন যারা ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ইজতেমার জন্য আসছেন।
এদের মধ্যে নুরানির মতো ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের রাজপরিবারের সদস্য পর্যন্ত সব ধরনের পেশার মানুষ রয়েছেন। তবে গত কয়েক বছর ধরে ইজতেমায় বিদেশীদের আসার হার আগের তুলনায় কিছুটা কম বলে মনে করছেন ইজতেমার আয়োজকরা।
তারা বলছেন, ২০১৭ সালে তাবলীগ জামাতের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসার পর থেকে ইজতেমায় অংশ নেয়া বিদেশীদের সংখ্যা কমে গেছে।
ভারতীয় উপমহাদেশে সুন্নি মুসলমানদের বৃহত্তম সংগঠন তাবলীগ জামাতের মধ্যে প্রথম দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ পায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে। এরপর করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে দুই বছর বিরতির পর বিশ্ব ইজতেমা আবারো শুরু হলেও, তাবলীগ জামাতের মধ্যে বিভক্তি কাটেনি।
এখন তাবলীগ জামাতের দুটি গ্রুপ আলাদাভাবে টঙ্গির তুরাগ নদীর পাড়ে বিশ্ব ইজতেমার পৃথক আয়োজন করে, যার প্রথম পর্বটি হয়েছে ১৩ থেকে ১৫ই জানুয়ারি। আর দ্বিতীয় পর্বটি হয়েছে ২০ থেকে ২২শে জানুয়ারি।
সূত্র : বিবিসি