চলমান কৃচ্ছ্র সাধনের পরোক্ষ প্রভাবেও থেমে নেই ফাস্টট্র্যাকভুক্ত মেগা ৮ মেগা প্রকল্পের কাজ।
শুরু থেকে গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত এসব প্রকল্পের আওতায় খরচ হয়েছে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৬৪৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। প্রকল্পগুলোর গড় ভৌত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৭৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৬৬ দশমিক ০৭ শতাংশ।
এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬ হাজার ২৬৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু এবং মেট্রোরেল (আংশিক) উদ্বোধন হলেও প্রকল্প শেষ হতে এখনো বেশ কিছুটা সময় বাকি। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) অগ্রগতি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
প্রকল্পগুলো হলো-পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ এবং দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু-মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিংগেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প।
জানতে চাইলে পরিকল্পনা বিভাগের সদ্য সাবেক সচিব মামুন-আল-রশীদ মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, কয়েকদিন আগে এনইসি সম্মেলন কক্ষে এডিপির সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। মোট উন্নয়ন বরাদ্দের প্রায় ৮২ শতাংশই রয়েছে এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বিভিন্ন প্রকল্পে। সেখানে কোনো প্রকল্প পরিচালক বলেননি যে ডলার সংকটে মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেই সঙ্গে কৃচ্ছ সাধনেরও কোনো প্রভাব অন্তত মেগা এই ৮ প্রকল্পের কোনোটিতেই পড়েনি। তবে পরোক্ষ কিছু প্রভাব থাকতে পারে, সেটি বড় সমস্যা নয়। ফাস্টট্র্যাকভুক্ত মেগা প্রকল্পের বাইরে কোনো কোনো বড় প্রকল্পে পিডি নিয়োগে বিলম্ব, দরপত্র প্রক্রিয়ায় দেরি এবং ডিজাইন সময়মতো না হওয়াসহ বেশ কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে। সেগুলো সমাধানেও টাইমলাইন বেঁধে দেওয়া হয়েছে ওই সভায়।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের ২৫ জুন উদ্বোধন করা হয় পদ্মা সেতু প্রকল্পের। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ হয়নি। গত নভেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটির আওতায় ব্যয় হয়েছে ২৮ হাজার ৫৩৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৯৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। পুরো প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৯৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। এটি বাস্তবায়নে মোট ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। প্রকল্পটির কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। কয়েক দফা মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। বহুল প্রত্যাশিত মেট্রোরেল প্রকল্পের উত্তরা-আগারগাঁও অংশ গত ২৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন হয়েছে। ২৯ ডিসেম্বর থেকে নির্ধারিত সময়ে জনগণের চলাচলের জন্য খুলে গেছে এ অংশটি। কিন্তু পুরো প্রকল্প শেষ হতে অপেক্ষা করতে হবে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। তবে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন চলতি বছরের শেষ নাগাদ মতিঝিল পর্যন্ত দ্বিতীয় অংশ খুলে দেওয়া হতে পারে। শুরু থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটির আওতায় ব্যয় হয়েছে ২০ হাজার ৫৩৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৬১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এছাড়া ভৌত অগ্রগতি ৬৫ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সংশোধিত ব্যয়সহ মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু দ্বিতীয় সংশোধনীতে ব্যয় বাড়ার সঙ্গে মেয়াদ বেড়েছে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এটির মূল ব্যয় ছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত বাড়তি অংশ যোগ হওয়ায় এই ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে দেশের সবচেয়ে বেশি ব্যয়ের প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। শুরু থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৫২ দশমিক ৯০ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৫৭ হাজার ২১৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৫০ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি ৫২ দশমিক ৯০ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ এ বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের উৎপাদন লক্ষ্য ছিল। কিন্তু কোভিড মহামারিতে সঞ্চালন লাইনের কাজ দেরি হওয়ায় কেন্দ্রটির উৎপাদন পিছিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ রূপপুর প্রকল্পটি উৎপাদনে আসতে পারে। সম্প্রতি এ তথ্য জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পে গত নভেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৬ হাজার ৩২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৬৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এছাড়া ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৬৭ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। এটি ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। এছাড়া মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম (১২টি প্রকল্পযুক্ত) প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। গত নভেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৯ হাজার ৭৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতি ৫৬ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং সার্বিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৬৯ দশমিক ২৬ শতাংশে।
এছাড়া রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। গত নভেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১২ হাজার ৫৬৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৭৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৮৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ। পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পটি ৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। গত নভেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৮২ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৮৭ দশমিক ৭১ শতাংশ। এছাড়া দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু-মিয়ানমারের কাছে ঘুনধুম পর্যন্ত সিংগেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। গত নভেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ১০০ কোটি ১৭ লাখ টাকা। প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৩৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এছাড়া ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৮৭ দশমিক ৭১ শতাংশ। এর আগে প্রকল্পটির পরিচালক (পিডি) মোহাম্মদ মফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেছিলেন, কৃচ্ছ সাধনের ফলে প্রকল্পের সার্বিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না। বলতে গেলে সরাসরি কোনো প্রভাব নেই। তবে গাড়ির তেলসহ প্রশাসনিক কিছু ব্যয় এখন কমানো হয়েছে। সেটি মূল প্রকল্পে প্রভাব পড়বে না।