চলতি মার্চ মাসে বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে গত ফেব্রুয়ারি থেকে এগোচ্ছিল বিএনপি। ঘোষণাও ছিল প্রায় একই রকম। দলটির পরিকল্পনা ছিল- ইউনিয়ন, উপজেলা-জেলা-মহানগর শেষে বড় আন্দোলন গড়ে তোলার। সে অনুযায়ী, গত ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশব্যাপী সর্বত্র পদযাত্রা কর্মসূচিও করে দলটি।
সর্বশেষ গত ৪ মার্চ অন্যান্য মহানগরের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো রাজধানী ঢাকায় ৫০ থানায় কেন্দ্রীয় নেতাদের নেতৃত্বে পদযাত্রা কর্মসূচি করে বিএনপি। এদিন বড় আন্দোলনের ঘোষণা না দিয়ে আগামী ১১ মার্চ জেলা ও মহানগরে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। রাজনৈতিক পরিবেশ, পরিস্থিতি, সরকারের মনোভাব এবং রাজধানী ঢাকার সাংগঠনিক প্রস্তুতিসহ সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে মার্চে বড় আন্দোলন করার চিন্তা থেকে সরে আসে বিএনপি।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলেন, ক্ষমতাসীনদের নানা বাধা অতিক্রম করায় ধারাবাহিকভাবে বিভাগীয় গণসমাবেশ তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা সফল করায় ‘আন্দোলনের পারদ’ বেশ উচ্চতায় উঠেছিল। বিএনপি নেতাদের বক্তব্যেও তা ফুটে ওঠে। কিন্তু ১০ ডিসেম্বরের ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ, নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।
দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, সব বাধা অতিক্রম করে সাংগঠনিক ৯ বিভাগে গণসমাবেশে নেতাকর্মী ও সমর্থকের বাইরে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের ফলে সরকার ভয় পেয়ে যায়। এ কারণে ১০ ডিসেম্বরের ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের ভেন্যু নিয়ে বিএনপি ও সরকারের মধ্যে টানাপড়েন দেখা দেয়। একপর্যায়ে ৭ ডিসেম্বর রাজধানীর নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়, যাতে ১ জন নিহতসহ অনেকে আহত হন। সেদিন দলীয় কার্যালয় থেকে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ সাড়ে চারশ নেতাকর্মীকে এবং পরের দিন গভীর রাতে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে নিজ নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ বিষয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের মূল্যায়ন, এসব ঘটনায় ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশের আগে আন্দোলনের পারদ ওপরের দিকে না উঠে নিচের দিকে নামতে থাকে। যদিও বিএনপি নেতাদের ভাষ্য- ওই সমাবেশ থেকে তারা যুগপৎ আন্দোলনের বড় বার্তা দিতে পেরেছেন। বড় নেতাদের জেলে নিলেও আন্দোলন থেমে থাকে না- এই বার্তাও দেওয়া গেছে। ওই সমাবেশ থেকে একযোগে জাতীয় সংসদ থেকে বিএনপির সাত এমপির পদত্যাগের ঘোষণা এবং পরে তা কার্যকর করা হয়। এর মধ্যে বিশেষ সফলতা হিসেবে মনে করা হচ্ছে ৫৪টি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে বিএনপির ১০ দফা সমর্থন করে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করা। এ অবস্থায় পরবর্তী কর্মসূচিগুলোতে ধীরে ধীরে আন্দোলনের গতি বাড়তে থাকে।
ইউনিয়ন পর্যায় থেকে ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি হবে উল্লেখ করে গত ৪ ফেব্রুয়ারি নয়াপল্টনে এক সমাবেশে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এবার ইউনিয়ন পর্যায় থেকে পদযাত্রা শুরু করব। এর পরে ধীরে ধীরে আমরা উপজেলা, জেলা ও মহানগর এবং এর পর তাদের যে ক্ষমতার মসনদ, সেই মসনদ জনগণ দখল করে নেবে, জনগণের সরকার গঠন করবে।’
এর পর গত ৪ মার্চ ঢাকাসহ অন্যান্য মহানগরে পদযাত্রা কর্মসূচি করে বিএনপি। ওই কর্মসূচি থেকে আগামী ১১ মার্চ জেলা ও মহানগরে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকা মহানগরে বিএনপি এককভাবে ৫টি পদযাত্রা কর্মসূচি করে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দেশে-বিদেশে একটা বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছি, দেশের মানুষ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। জনগণ বিশ্বাস করে, আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না- এ ব্যাপারে দেশের সবাই ঐক্যবদ্ধ। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। তারা বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেও বাধা দেয়। বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হামলা করেছে। এর পরও প্রতিটি কর্মসূচিতে মানুষের ঢল নেমেছে।
আন্দোলন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত নেতারা মনে করেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে পরাজিত করতে হলে বিএনপিকে আরও শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। গণসংযোগমূলক নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি করে চূড়ান্ত আন্দোলনে দিকে এগোতে হবে। এর মাধ্যমে আন্দোলনের সঙ্গে জনগণকে আরও সম্পৃক্ত করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি নিষ্ক্রিয় নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত এবং দলের মধ্যে বিভেদ দূর করে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে। এরই মধ্যে বেশ কিছু কাজ শুরু হয়েছে। বিশেষ করে সাবেক এবং বর্তমান জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের মূল টার্গেট চূড়ান্ত আন্দোলনের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে এই সরকারের বিদায় ঘটিয়ে ভোটাধিকার ফেরানো, বর্তমান সংসদ বিলুপ্ত করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা এবং এর অধীনে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করা। তাদের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটে দেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে- এটি হচ্ছে বিএনপির লক্ষ্য।