গত ২৪ মে রাতে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত নতুন ভিসানীতি বাংলাদেশের জন্য রয়েছে এক ‘স্পষ্ট বার্তা’। সংশ্লিষ্ট পক্ষ বিশেষত সরকার, বিরোধী দল, জুডিশিয়ারি, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী প্রশাসন, আমলাতন্ত্র নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিষয়টি বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি ভিসানীতি সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করেছে। ‘নতুন মার্কিন নীতি বরং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমাদের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করেছে। নীতিটি ভালো, এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমন মন্তব্য করলেও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে উদ্বেগের আভাস রয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়- ‘আমরা আশা করব, মার্কিন নতুন ভিসানীতির যথেচ্ছ ও নিবর্তনমূলক প্রয়োগ তাদের উদ্দেশ্য নয়। আইনটি অপেক্ষাকৃত নতুন। যেকোনো আইনের নতুন ধারায় প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন ও সংশয় থাকে। সে কারণেই বলেছি যে, এর যেন নিবর্তনমূলক ব্যবহার না হয়। বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর অব্যাহত অঙ্গীকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় সমর্থনকে সরকার সবসময় ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করে।’ এ ছাড়া চ্যানেল আইয়ের তৃতীয় মাত্রায় জিল্লুর রহমানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আমেরিকার সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বলেছেন, ভিসানীতিতে নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া ব্যক্তিদের মধ্যে নির্দেশদাতা ও নির্দেশগ্রহীতারাও পড়বেন। তাদের জন্যও ভিসা নিষেধাজ্ঞা হতে পারে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বিবৃতির ভাষা ক‚টনৈতিক ও পরিধি ব্যাপক। এটি পরিশীলিত ভাষায় প্রচ্ছন্ন ‘হুঁশিয়ারি’। এর তাৎপর্য অত্যন্ত নিগূঢ় ও দ্ব্যর্থহীন। এর লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা। ভিসানীতি সরকার ও বিরোধী দল উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ নীতির আওতায় যেকোনো বাংলাদেশী যদি সে দেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে দায়ী হন বা এরকম চেষ্টা করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়- তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাকে ভিসা দেয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে। আওতায় পড়বেন বর্তমান ও সাবেক বাংলাদেশী কর্মকর্তা, সরকার-সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সদস্য। গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে, এমন কাজের সংজ্ঞার মধ্যে রয়েছে চারটি স্তর- এক. ভোটারদের ভয় দেখানো; দুই. ভোট কারচুপি; তিন. সহিংসতার মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার প্রয়োগ করতে বাধা দেয়া এবং চার. বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীলসমাজ বা গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখা।
এ ভিসানীতি শুধু আমেরিকার মনে করলে ভুল হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত হলেও এতে রয়েছে জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, ব্রিটেন, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সরকারের ইচ্ছার প্রতিধ্বনি। পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অপ্রতিহত প্রভাব ও শক্তিমত্তা। মার্কিন নীতি বা নিষেধাজ্ঞাকে সাধারণত পশ্চিমা দেশগুলো অনুসরণ করে থাকে। এ নীতির ফলে সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল সুশীলসমাজের যে অংশ রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করত, তাদের রাজনৈতিক ব্যাখ্যার পরিবর্তন আসতে পারে। গুম, গায়েবি মামলা, ভয়ের সংস্কৃতি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ হ্রাস পেতে পারে। কোয়াডে যুক্ত হওয়ার ও ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি সমঝোতা স্বাক্ষরে বাংলাদেশের ওপর চাপ তৈরি হলো। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন স্বচ্ছ, সুষ্ঠু অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হলে এ ভিসানীতির প্রয়োজন হতো না। নতুন ভিসানীতি বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্সপ্রবাহে নেতিবাচক ধারা তৈরি করতে পারে। উল্লেখযোগ্য-সংখ্যক সরকার ও বিরোধীদলীয় নেতা, আমলা, বিচারক, সেনা কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন সদস্যের যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি রয়েছে। অনেকের ছেলেমেয়ে সেখানে চাকরি, ব্যবসায় বা পড়ালেখা করছেন। ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে তাদের চিত্তচাঞ্চল্য।
বাইডেন সরকার বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক শাসন আছে বলে মনে করে না। যদি করত তাহলে নিশ্চয় ২০২১ ও ২০২৩ সালে গ্লোবাল ডেমোক্র্যাসি সামিটে ঢাকা আমন্ত্রিত হতো। কর্তৃত্ববাদী সরকারকে প্রতিহত করা, দুর্নীতি দমন ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখা- এ তিন লক্ষ্যে অঙ্গীকার পূরণের অগ্রগতি এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ বিষয়ে সম্মেলনে আলোচনা হয়। ২০২১ সালের সম্মেলনে ১১০টি দেশের প্রায় ৭৫০ প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন। সেই সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। ২০২৩ সালের গণতন্ত্র সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের সহআয়োজক হিসেবে ছিল কোস্টারিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, নেদারল্যান্ডস ও জাম্বিয়া। সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও মালদ্বীপসহ বিশ্বের ১১১টি দেশ আমন্ত্রণ পেলেও বাংলাদেশ আমন্ত্রণ পায়নি।
বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন যে, ভিসানীতির পেছনে কি বাংলাদেশে একটি অবাধ-সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক নির্বাচন দেখতে যুক্তরাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা কাজ করেছে, নাকি এর পেছনে আরো কোনো গভীর ‘কৌশলগত’ হিসাব-নিকাশও আছে? ভ‚রাজনৈতিক লক্ষ্যভেদী স্বার্থ থাকাও বিচিত্র নয়। অতীত ঘটনাপ্রবাহ মনে করিয়ে দেয়, কাউকে ক্ষমতায় বসানো বা ক্ষমতা থেকে নামানোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথমে থাকে নিজের স্বার্থের প্রাধান্য। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা যদি বাইডেন প্রশাসনের অন্যতম অ্যাজেন্ডা হয়ে থাকে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের কর্তৃত্ববাদী রাজতান্ত্রিক সরকারগুলোর জন্য কেন ভিসানীতির ঘোষণা আসে না।
ওয়াশিংটনভিত্তিক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এটি বেশ কঠোর একটি সিদ্ধান্ত এবং এখানে একটি খুবই স্পষ্ট বার্তা দেয়া হয়েছে। মার্কিন প্রশাসন এখন দেখবে নির্বাচন ঘনিয়ে এলে সেখানে কী ঘটে। তার মনে হচ্ছে, জো বাইডেন প্রশাসনের গণতন্ত্র প্রসারের অ্যাজেন্ডার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে নেয়া হচ্ছে। বাইডেন প্রশাসন একটি মূল্যবোধভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি জোরালোভাবে প্রয়োগ করছে।
গত বেশ কিছু কাল ধরেই আমরা দেখছি বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের সরকারের ক্র্যাকডাউনের সমালোচনা করেছে, র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, ক‚টনৈতিক পন্থার বাইরে গিয়ে তারা প্রয়োজনে ‘শাস্তিমূলক পদক্ষেপ’ নিতেও ইচ্ছুক, এবং অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন, গণতন্ত্র ও অধিকার নিশ্চিত করতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতেও প্রস্তুত।’ (বিবিসি নিউজ বাংলা, ২৬ মে-২০২৩)