সরকারের ৭১ হাজার ৯১৬ টন ইউরিয়া সার আত্মসাৎ করেছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্স। এ কারণে আর্থিক ক্ষতি ৫৮২ কোটি টাকা। কিন্তু শিল্প মন্ত্রণালয়ের অনীহার কারণে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা পিছিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে অনুমতি চেয়ে ২০ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রলণালয়ে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)। কিন্তু ১৪ দিনেও মন্ত্রীর টেবিলে পৌঁছায়নি এ চিঠি। তবে বিসিআইসির যাবতীয় কার্যক্রম থেকে ১৫ ডিসেম্বর পোটন ট্রেডার্সকে নিষিদ্ধ করা হয়।
পোটন ট্রেডার্সের মালিক নরসিংদী-২ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য কামরুল আশরাফ খান পোটন। এছাড়াও সার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসাবে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
জানতে চাইলে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের চিঠি এলেও আমার কাছে আসেনি। কিন্তু আপনার কাছে গেল কীভাবে? এত গোপন বিষয় কে বা কারা পাঠায়? মন্ত্রণালয় আমি চালাই, না আপনি চালান, সেটি বুঝতে পারছি না। এটিই আমার বক্তব্য (কমেন্টস)।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘আমার কাছে ফাইল এলে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সবার জন্য একই নিয়ম। কারও জন্য আলাদা নিয়ম নেই। আমি নিজেও আইনজীবী। ফলে আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ হবে।’ জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ইউরিয়া সার আমদানির জন্য মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি দেশের সঙ্গে চুক্তি করে (জিটুজি) সরকার। চুক্তি অনুসারে সার সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো হলো সৌদি আরবের সাবিক, কাতারের মুনতাজাত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফার্টিগ্রোব। এই সার পরিবহণের জন্য ড্রাই বাল্ক শিপিং প্রাইভেট লিমিটেডের স্থানীয় প্রতিনিধি পোটন ট্রেডার্সের সঙ্গে ১৩টি চুক্তি করে সরকার। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে আমদানির পর জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করে সরকারি গুদামে পৌঁছে দেওয়ার কথা। আমদানি করা সারের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৯৩ হাজার ২৪৪ টন। আর পুরোটাই বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে বুঝে নিয়ে পরিবহণ করে বাংলাদেশে আনে। কিন্তু গুদামে সরবরাহ করে ৩ লাখ ২১ হাজার ৩২৮ টন। অর্থাৎ বিদেশ থেকে নিয়ে এলেও ৭১ হাজার ৯১৬ টন সার তারা গুদামে দেয়নি। এসব সরকারি সার বেসরকারিভাবে বিক্রি করে দিয়েছে পোটন ট্রেডার্স। এই সারের ক্রয়মূল্য ৫৫৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এর সঙ্গে অন্যান্য খরচ ২৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে সরকারের ক্ষতির পরিমাণ ৫৮২ কোটি টাকা। তবে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয় মূল্য এর চেয়ে আরও বেশি। এরপর সার সরবরাহের জন্য গত বছরের ২২ আগস্ট পোটন ট্রেডার্সকে চিঠি দেয় বিসিআইসি। পরবর্তী সময়ে আরও কয়েক দফা চিঠি দেওয়া হলেও একেবারে গুরুত্ব দেয়নি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি। বারবার ওয়াদা দিয়েও সার পৌঁছাতে ব্যর্থ হয় তারা। এর মধ্যে বাজারে সারের কিছুটা সংকট দেখা দেয়। ডিলাররাও এর সুযোগ নিয়ে দাম বাড়িয়েছে। এরপর ৩১ অক্টোবর শিল্প মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানানো হয়। পাশাপাশি ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিসিআইসি। ৮ ডিসেম্বর এ ব্যাপারে প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সার আমদানির পর সরকারের গুদামে না দিয়ে আত্মসাৎ করে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করেছে। তদন্ত করে বেসরকারি এসব গুদামে ১ হাজার ৩০৮ টন সরকারি সার পেয়েছে কমিটি। অন্যদিকে সরকারি গুদামে যেসব সার দিয়েছে, তার একটি অংশ ব্যবহারের উপযোগী নয়। এ অবস্থায় বিসিআইসির যাবতীয় কার্যক্রম থেকে ১৫ ডিসেম্বর থেকে পোটন ট্রেডার্সকে নিষিদ্ধ করা হয়। পাশাপাশি আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত চেয়ে গত ২০ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় বিসিআইসি। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত কোনো ধরনের সাড়া মেলেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে মন্ত্রীর অনুমতি লাগে। কিন্তু ১৪ দিনেও মন্ত্রীর কাছে চিঠির কপিই পৌঁছায়নি। এছাড়াও বারবার অপরাধ করেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির মালিক নরসিংদী-২ আসনের সাবেক এমপি কামরুল আশরাফ খান পোটন যুগান্তরকে বলেন, এটি অনেক আগের বিষয়। ইতোমধ্যে নিষ্পত্তি (সেটেল) হয়ে গেছে। আমরা সার দিতে শুরু করেছি। কিছু দেওয়া হয়েছে। বাকিটাও দিয়ে দেব।
জানা যায়, বিদেশ থেকে জাহাজে করে ব্যাগড ইউরিয়া সার আনার পর বন্দর থেকে সরাসরি গুদামে নিয়ে যাওয়া হয়। আর আমদানি করা বাল্ক ইউরিয়া নেওয়া হয় বিভিন্ন সার কারখানায়। দুই ক্ষেত্রেই সার স্থানান্তরের দায়িত্ব পরিবহণ ঠিকাদারের। বিসিআইসির কর্মকর্তারা বলছেন, এসব সার তাদের হাতে নেই। সারগুলো খোলাবাজারে বিক্রি করা হয়েছে। তবে অতিরিক্ত চাহিদার কারণে যে কোনো সময় সার সংকট দেখা দিতে পারে, যা পরে ফসলে প্রভাব পড়বে।
এদিকে নির্ধারিত সময়ে সার সরবরাহ না করায় একদিকে কৃষক প্রয়োজনীয় সার পাননি, অপরদিকে যারা পেয়েছেন, তাদেরও বাড়তি দামে কিনতে হয়েছে; যা ফসলের উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় পোটন ট্রেডার্স বিসিআইসির বিভিন্ন কারখানায় উৎপাদিত এবং আমদানি করা সার পরিবহণে ঠিকাদারির কাজ করে আসছে।
মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গত বছরে দেশে মোট রাসায়নিক সারের চাহিদা নিরূপণ হয় ৫৯ লাখ ৩৪ হাজার টন। এর মধ্যে ইউরিয়া ২৬ দশমিক ৫০ লাখ টন। এক্ষেত্রে দেশে উৎপাদন ৫০ শতাংশ। বাকিটুকু আমদানি করতে হয়। এছাড়াও টিএসপির চাহিদা ৭ দশমিক ৫০ লাখ, ডিএপি ৯ লাখ, এমওপি ৮ দশমিক ৫০ লাখ এবং এমএপির শূন্য দশমিক ৫০ লাখ টন। অন্যান্য রাসায়নিক সারের মধ্যে জিপসাম ৪ লাখ টন, জিংক সালফেট ১ লাখ ৩৩ হাজার, অ্যামোনিয়াম সালফেট ১০ হাজার, ম্যাগনেশিয়াম সালফেট ৮০ হাজার ও বোরন ৪১ হাজার টন। অন্যদিকে এনপিকেএস ৭০ হাজার টন নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব সারের বাজারমূল্য থেকে অনেক বেশি মূল্যে সারের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে প্রতিবছরই কৃষককে সার সংকটে পড়তে হচ্ছে। এসব চক্রের কাছে সরকারও অসহায়।