কানাডায় শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জারের হত্যাকে কেন্দ্র করে ভারত ও কানাডার মধ্যে কূটনৈতিক বিবাদ যেন থামছেই না। কানাডা জানিয়েছে, কূটনীতিকদের সুরক্ষা কবচ তুলে নেয়ায় ভারতীয় হুমকির মুখে তারা ৪১ জন কূটনীতিককে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে।
শুক্রবার জারি করা জবাবে ভারত বলেছে যে- আন্তর্জাতিক আইন মেনেই তারা কূটনীতিকদের সংখ্যায় সমতা আনার কথা বলেছিল।
বড় সংখ্যায় কূটনীতিক প্রত্যাহারের ফলে ভারতে তাদের ভিসা পরিষেবা ব্যাহত হবে বলে নিশ্চিত করেছে দিল্লিতে কানাডার দূতাবাস।
যেসব কানাডার নাগরিক ভারতে আছেন, তাদের সতর্ক করে দিয়ে একটি ট্র্যাভেল অ্যাডভাইসারিও জারি করা হয়েছে।
ভারত এর আগে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিল, কানাডার সুনির্দিষ্ট ২১ জন কূটনীতিককে না সরানো হলে তাদের কূটনৈতিক সুরক্ষা-কবচ তুলে নেয়া হবে।
ভারতের ওই হুঁশিয়ারিকে কানাডার কর্মকর্তারা ‘আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।
আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন?
কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জলি এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেন যে- ভারতে তাদের দূতাবাসের ওই কূটনীতিক আর তাদের পরিবার নিরাপদেই দেশে ফিরে গেছেন।
মিজ জলি জানান, ভারত একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে- ২১ জন বাদে বাকি সব কূটনীতিক এবং তাদের পরিবারের কূটনৈতিক সুরক্ষা কবচ ২০ অক্টোবরের মধ্যে তুলে নেয়া হবে।
তার কথায়, ভারতের এই সিদ্ধান্তের ফলে কূটনীতিকদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে আমরা তাদের ভারত থেকে নিরাপদে সরিয়ে এনেছি। কানাডার অন্য ২১ জন কূটনীতিক অবশ্য এখনো ভারতেই আছেন। কিন্তু বাকিদের প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে কর্মীর ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী কথায় এটা অবশ্য স্পষ্ট হয়নি যে কোন ২১ জন কূটনীতিককে ভারতে রেখে দেয়া হয়েছে আর কাদের দেশে ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
কূটনীতিকদের সুরক্ষা কবচ সরিয়ে নেয়া ভারতের সিদ্ধান্তকে ‘অযৌক্তিক এবং নজিরবিহীন আর ভিয়েনা কনভেনশন স্পষ্টতই লঙ্ঘন করেছে’ বলেও মন্তব্য করেন মিজ জলি।
ভারতের কড়া জবাব
কানাডার ওই মন্তব্যের বেশ কড়া জবাব দিয়েছে ভারত। শুক্রবার দুপুরে এক বিবৃতি জারি করে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছেন, ভারতে কানাডার কূটনৈতিক উপস্থিতি নিয়ে গত ১৯ অক্টোবর কানাডা সরকারের বিবৃতি আমরা দেখেছি। আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবস্থা, ভারতে কানাডার কূটনীতিকদের উপস্থিতির সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তাদের অব্যাহত হস্তক্ষেপের কারণে নয়াদিল্লি এবং অটোয়ায় কূটনৈতিক উপস্থিতির পারস্পরিক সমতার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে যে- কূটনীতিকদের সংখ্যায় সমতা রাখা ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী স্বীকৃত ব্যবস্থা। এটাকে যেভাবে আন্তর্জাতিক রীতি লঙ্ঘন হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, তা মানা যায় না বলেও ভারত জানিয়েছে।
ভিসা প্রদান ব্যাহত
কানাডা তাদের ৪১ জন কূটনীতিককে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরে ভারতে কানাডার ভিসা সেবাসহ সব ধরনের কনসুলার সার্ভিস ব্যাহত হবে।
কানাডা দূতাবাস বলছে মুম্বাই, বেঙ্গালুরু ও চন্ডিগড় থেকে কনসুলার পরিষেবা আপাতত বন্ধ রাখা হচ্ছে। ওই তিনটি শহরে কানাডার উপদূতাবাস থেকে ভিসা এবং কানাডার নাগরিকদের কনসুলার পরিষেবা বন্ধ হলেও দিল্লির দূতাবাস থেকে ভিসা দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
ভিসা এবং কনসুলার পরিষেবা আবার কবে থেকে শুরু হতে পারে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কর্মকর্তারা।
তবে কানাডার অভিবাসনমন্ত্রী মার্ক মিলার সামাজিক মাধ্যম ‘এক্স’-এ এক পোস্টে জানিয়েছেন যে- কর্মী ঘাটতির ফলে ভিসার আবেদন খতিয়ে দেখতে সময় বেশি লাগবে।
এর ফলে সবথেকে বেশি সমস্যায় পড়বেন যেসব ভারতীয় ছাত্রছাত্রী কানাডায় পড়াশোনার জন্য যেতে ইচ্ছুক, তারা।
স্থায়ী এবং অস্থায়ীভাবে কানাডায় বসবাস করতে ইচ্ছুক এমন বিদেশীদের মধ্যে সবথেকে আবেদন জমা পড়েছিল ভারতের নাগরিকদের কাছ থেকেই।
ভ্রমণ সতর্কতা জারি
কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পরেই ভারতে অবস্থানরত কানাডার নাগরিকদের উদ্দেশে এক সতর্কবার্তা দেয়া হয়।
হালনাগাদ করা ‘ট্র্যাভেল অ্যাডভাইসারি’তে লেখা হয়েছে ‘ভারত ও কানাডায় সাম্প্রতিক ঘটনাবলী’র পরে কিছু বিক্ষোভের ডাক দেয়া হয়েছে এবং গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে কানাডাকে নিয়ে একটা নেতিবাচক ভাবাবেগ তৈরি হয়েছে।
‘কানাডা বিরোধী বিক্ষোভ দেখানো হতে পারে এবং কানাডার নাগরিকদের হয়রানি ও হুমকির মুখে পড়তে হতে পারে। দিল্লি ও জাতীয় রাজধানী অঞ্চলে অচেনা মানুষের সামনে একটু চুপচাপ থাকবেন এবং কখনই ব্যক্তিগত তথ্য তাদের দেবেন না,’ বলা হয়েছে ওই ট্র্যাভেল অ্যাডভাইসারিতে।
ভ্রমণের সময় সবসময়ে অন্য কাউকে সাথে রাখতে আর কবে, কোথায় যাচ্ছেন, সেটা কোনো বন্ধু বা পরিবারের সদস্যকে জানিয়ের রাখতেও পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কেন অবনতি
কানাডার নাগরিক এক শিখ ধর্মাবলম্বী বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জারের হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে ভারত আর কানাডার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাস থেকে।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো দেশটির পার্লামেন্টে বলেছিলেন, হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় এজেন্সির জড়িত থাকার যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে।
ওই হত্যাকাণ্ডকে কানাডা তার সার্বভৌমত্বে আঘাত বলে বর্ণনা করেছিল।
তারপর থেকেই দু’দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়।
তবে ভারত এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একাধিকবার বলেছে, কানাডা যদি তার দাবির সমর্থনে প্রমাণ হাজির করে, তাহলে ভারত অবশ্যই তা বিবেচনা করবে।
কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সারে শহরের একটি গুরুদুয়ারার বাইরে মুখোশধারী দুই বন্দুকধারীর গুলিতে নিজ্জার নিহত হন। কানাডার পুলিশ একে ‘টার্গেট অ্যাটাক’ বলে অভিহিত করেছে। এই মামলার তদন্ত এখনো চলছে।
নিজ্জারকে সন্ত্রাসবাদী হিসাবে ঘোষণা করেছিল ভারত।
সূত্র : বিবিসি