শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশটির কিছু গণমাধ্যম বাংলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার কাল্পনিক সংবাদ অতিরঞ্জিত করে প্রচার করছে। এতে কেবল ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হলেও তা এ দেশের হিন্দুদের কোনো কাজে আসছে না। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার এক প্রতিবেদককে দেবরাজ ভট্টাচার্য নামে ঢাকার একজন ৪২ বছর বয়সী হিন্দু ব্যাংকার বলেন, ‘কিছু বিশেষ ভারতীয় মিডিয়া, যেভাবে বিজেপির সাথে জোটবদ্ধ হয়ে বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে ভয়ের পরিবেশ ছড়াচ্ছে তা আমাদের এখানে কোনো সাহায্য করছে না।’ তিনি ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) কথা উল্লেখ করছিলেন।
একটি স্বাধীন বাংলাদেশী তথ্য-পরীক্ষা সংস্থা রিউমর স্ক্যানারের তদন্ত অনুসারে, ১২ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ পর্যন্ত ৫০টির মতো ভারতীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ সম্পর্কে কমপক্ষে ১৩টি মিথ্যা প্রতিবেদন প্রচার করেছে। দেবরাজ বলেন, তবুও, হাসিনার পতনের পর থেকে, হিন্দু সম্প্রদায়গুলোকে যে ভয় এবং নিরাপত্তাহীনতা গ্রাস করছে তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বেশির ভাগ গ্রামাঞ্চলে যারা হাসিনার শাসনামলে খুব বেশি আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি তারা এখন শক্তিতে আছে। দেবরাজ বলেন, এতে বাংলাদেশে হিন্দুরা বরং দ্বিগুণ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
দেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (বুয়েট) ২৭ বছর বয়সী হিন্দু ছাত্র অভিরো শোম পিয়াস বলেন, আমাদের ধর্মীয় তীর্থস্থানগুলোর ৯০ শতাংশ ভারতে অবস্থিত এবং সেখানেই আমাদের সংযোগ রয়েছে। তবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশী হিন্দুরা বর্তমান ভারত সরকার বা এর ‘হিন্দুত্ব’ চরমপন্থাকে সমর্থন করে না। তিনি বিজেপির হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ মতাদর্শকে উল্লেখ করে এ ধরনের মন্তব্য করেন।
দোয়ারাবাজার মার্কেটের ২৯ বছর বয়সী একজন ফার্মেসি মালিক, যিনি তার পুরো নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভারতীয় মিডিয়া ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে এবং ঘটনাগুলোকে অতিরঞ্জিত করে, যার মধ্যে কিছু কখনও ঘটেইনি। এটি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারত-বিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তোলে, যা আমাদের হিন্দুদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি সৃষ্টি করে।
৮৪ বছর বয়সী নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ভারতীয় মিডিয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর হামলার অতিরঞ্জিত খবর প্রচারের অভিযোগ তুলেছে। ইউনূসের প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম আলজাজিরাকে বলেন, হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর কিছু হামলা হয়েছে। কিন্তু, ‘ভারতীয় মিডিয়ায় রিপোর্ট করা অনেক ঘটনা অতিরঞ্জিত এবং ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তির একটি শিল্প পর্যায়ে প্রচারের অংশ। অন্তর্বর্তী সরকার ধর্মের স্বাধীনতা, মেলামেশার স্বাধীনতা এবং সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য সমাবেশের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
কিছু হিন্দু যুক্তি দেখান যে, শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশে সম্প্রদায়টির নিরাপদ থাকার ধারণাটিও ভুল। দেবরাজ স্মরণ করেন, দুই একর (প্রায় ০.৮ হেক্টর) পারিবারিক জমি হারিয়েছেন আওয়ামী লীগের একজন সাবেক সংসদ সদস্যের কর্মীদের হাতে, যিনি গত সেপ্টেম্বরে ‘চাঁদাবাজি ও প্রাণনাশের হুমকির’ অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। তিনি বলেন, হাসিনার অধীনে হিন্দুরাও নিরাপদ ছিল না। আমাদের রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ শাসনামলে অনেক হিন্দু যে নিরাপত্তা অনুভব করেছিলেন তা বাস্তবের চেয়ে বেশি মানসিক ছিল।’
ভারতের নয়াদিল্লির উপকণ্ঠে জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের একজন অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ শ্রীরাধা দত্ত আলজাজিরাকে ব্যাখ্যা করেছেন যে, হাসিনা প্রশাসনের অধীনে হিন্দুদের সুরক্ষার উপলব্ধি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নিহিত। যদিও আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ঘটেছে তবুও পার্টির ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান সাধারণত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোকে এক ধরনের নিরাপত্তার অনুভূতি দেয়।
সংখ্যালঘু অধিকার গোষ্ঠী, বিএইচবিসিইউসি, এর আগে হাসিনা প্রশাসনের সময় ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের জুলাইয়ের মধ্যে ৪৫টি হত্যার রিপোর্ট করেছিল, যাদের বেশির ভাগই হিন্দু ছিল।
বাংলাদেশের একটি খ্যাতনামা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান আইন ও সালিস কেন্দ্র, জানুয়ারি ২০১৩ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর কমপক্ষে ৩,৬৭৯টি হামলার রিপোর্ট করেছে, যার মধ্যে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং লক্ষ্যবস্তু সহিংসতা রয়েছে। এর অনেকগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে।
২০২১ সালে, দুর্গাপূজার সময় এবং পরে বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের বাড়ি এবং মন্দিরে আক্রমণের পরে, অধিকার গোষ্ঠী অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছিল, ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই ধরনের বারবার আক্রমণ, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও উপাসনালয় ধ্বংস করা বছরের পর বছর দেখায় যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের রক্ষার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।’
বিএইচবিসিইউসির সভাপতি মণীন্দ্র কুমার নাথ বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু আন্দোলন ভারত এবং শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ উভয়ের থেকে স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন। এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। একটি সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন এবং একটি সংখ্যালঘু কমিশন প্রতিষ্ঠার দাবি দীর্ঘদিন ধরে করে আসছি। নাথ আরও উল্লেখ করেন যে, হিন্দু ছাত্ররা প্রতিবাদ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল যা হাসিনার সরকারকে অপসারণের দিকে পরিচালিত করে। তারা অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি এবং দাবির প্রতিবাদে একত্র হয়েছিল যেগুলো হাসিনা অনেক দিন ধরে উপেক্ষা করেছেন।
হাসিনা সরকারের সাবেক মন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এখন ভারতে নির্বাসিত, তবে তার দলের ট্র্যাক রেকর্ড রক্ষা করেছেন। তিনি আলজাজিরাকে বলেন, ‘আপনি যদি হিন্দুদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে আমাদের অধীনে যা ঘটেছিল তার সাথে তুলনা করেন, পার্থক্যটি স্পষ্ট। আমাদের শাসনামলে কিছু হামলা হয়েছে, আমরা তা অস্বীকার করতে পারি না। তবে ৫ আগস্টের পর যা ঘটছে তা নিছক বর্বরতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন, তারা [অন্তর্বর্তীকালীন সরকার] সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা মুছে ফেলার চেষ্টা করছে।’
বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল, মো: আসাদুজ্জামান, অক্টোবরে হাইকোর্টে শুনানির সময় পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, তিনি সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা অপসারণকে সমর্থন করবেন। তিনি বলেন, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা এমন একটি জাতির বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে না যেখানে জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলিম। মণীন্দ্র কুমার নাথ সতর্ক করে বলেন, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা অপসারণ করা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারকে উল্লেখযোগ্যভাবে হুমকির মুখে ফেলবে। অতীতে সরকারগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে আমাদের সুরক্ষা এবং অধিকারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু একবার ক্ষমতায় এসে তারা তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে।
ভট্টাচার্য সেই উদ্বেগের প্রতিধ্বনি করে বলেন, সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বের করা হলে, এটি একটি স্পষ্ট বার্তা দেবে যে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আর রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য আসল চ্যালেঞ্জ অন্য কোনো দেশের ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা নয়, বরং হিন্দু সংখ্যালঘুরা যাতে আবার নিরাপদ বোধ করে সে দিকে নজর দেয়া উচিত।