ভর্তুকির অর্থ দ্রুত পরিশোধের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে আবার তাগিদ দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এই পর্যায়ে ভর্তুকির সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা জরুরি ভিত্তিতে দেয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং ফার্নেস অয়েলের ওপর থেকে কর-শুল্ক অব্যাহতি প্রত্যাহার করার জন্য এই খাতে ব্যয় বেড়েছে ২৮.৫০ ভাগ। ফলে বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রির অব্যাহতি কারণে ক্রমেই বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে চলেছে। কিন্তু ভর্তুকির অর্থ পেতে এখন মন্ত্রণালয়ের বেগ পেতে হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ক্রয়মূল্য অপেক্ষা কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রয় করায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বাবিউবো) ট্যারিফ ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৫৪৭ কোটি ৮ লাখ টাকা।
অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর পাঠানো বিদ্যুৎ বিভাগের চিঠিতে বলা হয়, ক্রয় মূল্য অপেক্ষা কম দরে বিদ্যুৎ বিক্রয় করায় আইপিপি, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার এবং ভারত থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুতের মূল্য যথাসময়ে পরিশোধ করা এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে পূর্বের ধারাবাহিকতায় ভর্তুকি বাবদ আর্থিকসহায়তা প্রয়োজন।
এ অবস্থায় গত ২০২২ সালের মে-জুন-জুলাই মাসের ট্যারিফ ঘাটতি বাবদ ১৩ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা এবং একই বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরের ট্যারিফ ঘাটতি বাবদ ৮ হাজার ৯৬৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ভর্তুকি হিসেবে বাবিউবিকে আর্থিকসহায়তা প্রদানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সরকারের আর্থিকসহায়তায় বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিয়োজিত আইপিপি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাসিক বিদ্যুৎ বিল এবং ভারত থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধসহ বিউবো’র কেন্দ্রগুলোতে জ¦ালানি তেল সরবরাহের জন্য ‘বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন’ (বিপিসি)-কে অগ্রিম অর্থ প্রদান করে বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে পর্যাপ্ত পরিমাণ তরল জ¦ালানি মজুদ রাখা প্রয়োজন। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোকে গত ২০২২ সালের জুন থেকে মাসিক বিল পরিশোধ না করায় তাদের পক্ষে পর্যাপ্ত জ্বালানি তেল মজুদ রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
সূত্রমতে, সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির (তেল ও কয়লা) মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিউবোর গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বহুলাংশে বেড়েছে। পাশাপাশি গত ২০২০ সালের জুন থেকে ফার্নেস অয়েলের আমদানি শুল্ক ও কর অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করায় শুধু শুল্ক বাবদই ব্যয় ২৮ দশমিক ৫০ শতাংশ বেড়েছে।
বাউবির হিসাব মতে, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, ফার্নেস অয়েলের আমদানি শুল্ক ও কর অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার এবং ডলারের দাম বাড়ার কারণে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ২৫৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। বর্তমানে আইপিপি, রেন্টাল ও বিভিন্ন সরকারি কোম্পানির গত বছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার মাসের পরিশোধিতব্য বিলের প্রায় ২৫ হাজার ২১১ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এর মধ্যে শুধু আগস্টে ট্যারিফ ঘাটতি দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৪৮৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
বাউবি বলছে, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানের চাহিদাকৃত ভর্তুকির অর্থ জরুরি ভিত্তিতে ছাড় করা প্রয়োজন। সরকারের আর্থিক সহায়তা সময়মত প্রাপ্ত হলে আইপিপি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসহ ভারত থেকে ক্রয়কৃত বিদ্যুতের বিল নির্ধারিত সময়ে পরিশোধপূর্বক বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, করোনা-উত্তর চাহিদা বেড়ে যাওয়া, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও এলএনজির মূল্যবৃদ্ধি এবং সর্বশেষ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকারের ওপর ভর্তুকির চাপ বাড়ছে। বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি ব্যয় বেড়েই চলেছে।
সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ থেকে গত অর্থবছরের কয়েকমাসের ভর্তুকির টাকা প্রদান করা হচ্ছে। প্রতি তিন মাস অন্তর বিউবোকে ভর্তুকি অর্থ প্রদান করে থাকে অর্থ বিভাগ। এই খাতে আরো ৩২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।
গত ১১ বছরে শুধু বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিতে হয়েছে প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকা। এর বেশির ভাগই বেসরকারি খাতে তৈরি হওয়া ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, দেশে এখন বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে ১৫২টি। সাধারণভাবে অর্ধেক বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে আছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস’ (আইইইএফএ) ২০২০ সালে এক প্রতিবেদনে জানায়, দেশে ৫৭ ভাগ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রেখে কেন্দ্রভাড়া দেয়া হয়। তবে এখন এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় তেলভিত্তিক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বড় একটি অংশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না।