সমাজের প্রান্তিক মানুষের ব্যাংকের আমানত কমে গেছে। কৃষক, গার্মেন্ট শ্রমিক, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বিশেষ সুবিধায় ব্যাংকে হিসাব খুলতে পারেন। এর আওতায় ব্যাংকগুলোতে দুই কোটি ৬২ লাখ হিসাব খোলা হয়েছে। এসব হিসাবে আমানত বাড়ার হার তিন মাসে কমেছে প্রায় সোয়া ১১ শতাংশ। এক বছরের হিসাবে কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ। একই সময়ে নতুন হিসাব খোলার সংখ্যাও কমেছে। গতকাল রোববার প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতি তিন মাস পরপর এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। সেই সাথে দফায় দফায় বাড়ছে বিভিন্ন সেবা ব্যয়। গত দুই মাসেই তিন দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। গ্যাস সঙ্কটের কারণে অনেক শিল্পকারখানার উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। আবার ডলার সঙ্কটের কারণে প্রয়োজনীয় এলসি খুলতে পারছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনোটির উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে। মানুষ বাড়ছে, কিন্তু বর্ধিত হারে কর্মসংস্থান বাড়ছে না, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিদ্যমান কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। এর ফলে মানুষ অভাবের তাড়নায় নতুন করে সঞ্চয় করতে পারছেন না, বরং অনেকেই সঞ্চয়ই ভেঙে খাচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকিং খাতে আমানত প্রবাহ কমে যাচ্ছে। এখন জানা গেল বিশেষ সুবিধা খোলা দরিদ্র মানুষের হিসাবেও আমানতের প্রবৃদ্ধি কমছে। সরকারি হিসাবেই গত ডিসেম্বর পর্যন্ত জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে পৌনে ৯ শতাংশ। একই সময়ে গড়ে আয় বেড়েছে সোয়া ৭ শতাংশ। জীবনযাত্রায় ঘাটতি থাকছে প্রায় দেড় শতাংশ। এতে মানুষের সঞ্চয় কমেছে।
জানা গেছে, স্বল্প আয়ের মানুষকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে তাদের জন্য বিশেষ সুবিধায় হিসাব খোলা হচ্ছে। বিশেষ করে ১০, ২০, ৫০ বা ১০০ টাকা জমা দিয়ে এসব হিসাব খোলা যায়। এগুলোর বিপরীতে কোনো ফি নেয়া হয় না। এসব হিসাবে গ্রাহকরা সব ধরনের ব্যাংকিং সুবিধা নিতে পারেন। তাদেরকে কম সুদে ঋণ দেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক দু’টি বিশেষ তহবিল গঠন করেছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ২০০ কোটি টাকা ও অপরটি ৫০০ কোটি টাকার। এসব তহবিল থেকে তাদেরকে কম সুদে বিনা জামানতে ঋণ দেয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন হতে দেখা যায়, আলোচ্য হিসেবে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের থেকে ডিসেম্বরে আমানত বেড়েছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে বেড়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে আমানত কমেছে প্রায় সোয়া ১১ শতাংশ। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ডিসেম্বরে হিসাব খোলার হার বেড়েছিল ২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ১৮ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে হিসাব খোলার হার ১ শতাংশের বেশি কমেছে। এক বছরে হিসাব খোলা কমেছে প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে হিসাব সংখ্যা বেড়েছিল ১০ দশমিক ৬৩ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরে বেড়েছে মাত্র ৫ শতাংশ।
সূত্র জানায়, করোনার পর থেকে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব দেশের বাজারেও পড়েছে। এতে অনেক গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া নতুন গার্মেন্টসহ অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে না; যে কারণে এর আওতায় হিসাব খোলার সংখ্যা কমেছে।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে এসব গ্রাহকের আমানত ছিল তিন হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে আমানত প্রবাহ বেড়েছে ৩ দশমকি ৭৫ শতাংশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আমানত ছিল দুই হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা। এক বছরের হিসাবে আমানত বেড়েছে ২০ দশমকি ৫২ শতাংশ।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ডিসেম্বরে তিন মাসে আমানত বেড়েছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। এক বছরের হিসাবে বেড়েছিল ২৬ দশমিক ২৩ শতাংশ। তিন মাসের হিসাব আমানত কমেছে সোয়া ১১ শতাংশ এবং এক বছরের হিসাবে কমেছে প্রায় ৬ শতাংশ।
গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর সময়ে তিন মাসে কৃষকের আমানত কমেছে সাড়ে ৬ শতাংশ, আগের বছরের একই সময়ে তা বেড়েছিল ৫ দশমকি ৬৬ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরে অতি দরিদ্রদের আমানত বেড়েছিল ৯ দশমিক ১৪ শতাংশ। ২০২১ সালের একই সময়ে বেড়েছিল ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ। তবে এক বছরের হিসাবে তাদের আমানত কমেছে ৬ দশমিক ১১ শতাংশ।
আলোচ্য তিন মাসের হিসাবে মুক্তিযোদ্ধাদের আমানত বেড়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে বেড়ে ছিল সাড়ে ২৩ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সুবিধাপ্রাপ্তদের আমানত বেড়ে ছিল প্রায় ২ শতাংশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তা বেড়ে ছিল সোয়া ১৯ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে গার্মেন্ট শ্রমিক আমানত বেড়েছে সোয়া ২ শতাংশ।