বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা এখন শোকে মুহ্যমান। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তার লাশ দাফন সম্পন্ন হয়।
ছেলেকে হারিয়ে নিজের কষ্টের কথা জানান দিচ্ছিলেন বুয়েটের ছাত্র ফারদিনের বাবা কাজী নূর উদ্দিন রানা। তিনি বলেন, ‘শত্রুতার কারণে আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। ওর লাশের সাথে মানিব্যাগ, ব্লুট্রুথ, অকেজো মোবাইল, ঘড়ি সব-ই পাওয়া গেছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।’
বিলাপের সুরে ফারদিনের বাবা বলছিলেন ‘তিনিও সন্তানের মা, তিনি বোঝেন, সন্তান হারালে কিভাবে একটা পরিবারের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। মেধাবী ছাত্রদের এভাবে মেরে ফেললে দেশের ভবিষ্যত কী দাঁড়াবে ? ২৫ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা স্বপ্ন আমার, আজ হত্যাকাণ্ডের শিকার।’
মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টায় নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ছেলের লাশ সামনে নিয়ে তিনি এভাবেই শোক প্রকাশ করেন।
ফারদিনের বাবা জানান, শুক্রবার রাতে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তারা ছেলেকে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। এরপর শনিবার রামপুরা থানায় জিডি করেন। পুলিশ ঘটনাটির তদন্ত করছিল। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারদিন গত শনিবার থেকে নিখোঁজ ছিলেন।
সোমবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের লক্ষীনারায়ণ কটন মিলের পেছনে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় তার একজন ছেলে বন্ধু ও এক বান্ধবীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ।
ফারদিনের বাবা বলেন, শনিবার ছেলের টার্ম পরীক্ষা ছিল। সেজন্য সে শুক্রবার দুপুরে বাসা থেকে বের হয়েছিল। ওই দিন রাত ১১টার পর থেকে ছেলের মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়। শনিবার সে যখন পরীক্ষায় অংশ নেয়নি তখন তারর বন্ধু ও শিক্ষকরা বাসায় ফোন দেন। তারপর থেকে পরিবার খোঁজাখুঁজি শুরু করে। খোঁজ না পেয়ে পরিবার থানায় জিডিও করে।
তিনি জানান, শুক্রবার রামপুরা থানা এলাকায় পরশ তার এক বান্ধবীকে নামিয়ে দিতে আসে। সে কোনো রাজনীতি সাথে সম্পৃক্ত ছিলো না।
পরশকে নিয়ে বাবা নূর উদ্দিন আরো বলেন, পরশ রুটিন ধরে পড়াশুনা করত। পড়ালেখায় অনেক মনযোগী ছিল। সে বুয়েট, ঢাবিসহ তিন জায়গায় ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল। পরে সে বুয়েটে ভর্তি হয় কিন্তু হলে যায়নি। তার ভর্তির কিছু দিন পর আবরাব হত্যাকাণ্ড ঘটে। এরপর থেকে ছেলে আর হলে যেতে চাইনি। যে ভয়ে ছেলেকে বুয়েটের হলে আমরাও যেতে বলিনি আজ সেটাই সত্যি হল।
নূর উদ্দিন বলেন, এভাবে যদি আমরা এক একটা মেধাবী ছাত্র হারাতে থাকি, তাহলে ভবিষ্যত কী হবে? কয়েক দিন পরে স্পেনের একটা আন্তজার্তিক বির্তক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল পরশের। এজন্য নতুন এনআইডি কার্ড, পাসপোর্ট করা হয়েছে। কিন্তু তার আগেই পরশ হত্যার শিকার হল।
নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) শেখ ফরহাদ বলেন, নিখোঁজের ৭২ ঘণ্টা পর নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর ওরফে পরশকে হত্যা করা হয়েছে।
মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে তিনি এই তথ্য জানান।
ডা. শেখ ফরহাদ জানান, পরশের পুরো মাথা ও বুকে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। সেগুলোর কোনোটাই সামান্য আঘাত নয়। তার ভিসেরা পাঠিয়েছি, দু’/তিন দিন পর বলতে পারা যাবে সে কিভাবে মারা গেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, অবশ্যই এটা হত্যাকাণ্ড।
তিনি বলেন, ‘ফারদিনের পুরো মাথার বিভিন্ন অংশে আঘাত পাওয়া গেছে। বুকের ভেতরে আঘাতের চিহ্ন আছে। প্রাথমিকভাবে আমরা বুঝতে পেরেছি, এটি অবশ্যই হত্যাকাণ্ড। ময়নাতদন্ত শেষে দ্রুত প্রতিবেদন দেয়া হবে।
ফারদিনের বাবা কাজী নূর উদ্দিন বিজনেস পত্রিকা ‘দ্য রিভারাইন’-এর সম্পাদক ও প্রকাশক। ফারদিনের মা ফারহানা ইয়াসমিন একজন গৃহিণী। তাদের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা উপজেলায়। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ছিল ফারদিন। পড়াশোনায় মেধাবী ফারদিন এসএসসি ও এইচএসসিতে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছিলেন। গবেষণায় আগ্রহ ছিল ফারদিনের। তিনি নিজের ইচ্ছায় বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন ।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মশিউর রহমান মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জানান, বুয়েট ছাত্র ফারদিনের লাশটি সিদ্ধিরগঞ্জ থানার নদী এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। এখনো থানায় কেউ মামলা এজাহার দেয়নি। শুনেছি লাশের জানাযা দাফন নিয়ে ব্যস্ত আছে পরিবার। এজাহার পেলেই আমরা দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নিয়ে মাঠে নামব। তবে দুজন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুজনকে ঢাকায় আটক করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে হত্যার আলামত পাওয়া গেছে। এ হত্যার বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়ে গেছে।
ফতুল্লার দেলপাড়ার দাফন
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা পাগলা দেলপাড়া কেন্দ্রীয় কবরস্থানে তৃতীয় জানাযা শেষে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় দেলপাড়া কেন্দ্রীয় কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
এর আগে বিকেল সোয়া ৫টায় ফ্রিজিং গাড়িতে ফারদিন নূর পরশের লাশ দেলপাড়া কেন্দ্রীয় কবরস্থানে আনা হয়। এ সময় তার বাবা কাজী নূর উদ্দিন রানা, চাচা আবু ইউসুফ, ছোট ভাই সালেহ নুর, তাদের বন্ধুরাসহ পরিবারের অনেকে সাথে ছিলেন।