ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের সঙ্গে ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির নেতাদের সাক্ষাৎ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ২৭ সেপ্টেম্বর যা ঘটেছে, তা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক।
নতুন কমিটি গঠিত হওয়ার পর ক্যাম্পাস থেকে ‘নির্বাসিত’ ছাত্রদলের নেতারা উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পাওয়ার পরই সরকার–সমর্থক ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ওই ছাত্রসংগঠনকে প্রতিহত করার কর্মসূচি নেয়। এর মাধ্যমে তাঁরা যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, তেমনি আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। এরপরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নীরবতা অমার্জনীয়।
উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে ছাত্রদলের নবগঠিত কমিটির নেতা-কর্মীরা পশ্চিম দিকের ‘মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ’ দিয়ে প্রবেশ করেন। এরপর উপাচার্যের ভবনে যাওয়ার জন্য যখন তাঁরা স্যার এফ রহমান হলের সামনে এসে পৌঁছান, তখন ওই হলের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ক্রিকেটের স্টাম্প ও লাঠিসোঁটা নিয়ে তাঁদের ওপর হামলা করেন।
এতে ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ অন্তত ১৫ জন আহত হন এবং কয়েকজনকে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়। যেখানে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এ হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন, তার পাশেই নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ি।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকা কেবল পক্ষপাতমূলক নয়, কাপুরুষোচিতও। উপাচার্য ছাত্রদলের নবগঠিত কমিটির নেতাদের সাক্ষাতের অনুমতি দেওয়ার পর ছাত্রলীগ ওই সংগঠনকে ‘প্রতিহত’ করার ঘোষণা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিশ্চয়ই প্রতিহত করা শব্দের অর্থ অজানা নয়।
এ অবস্থায় তাদের উচিত ছিল ক্যাম্পাসে যাতে অপ্রীতিকর কিছু না ঘটে, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। ছাত্রলীগের এ ঘোষণার পর অনেকেই যখন ক্যাম্পাসে অপ্রীতিকর কিছু ঘটার আশঙ্কায় ছিলেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিশ্চিন্তে ছিল কীভাবে? নাকি তারা নিজেরাই চাইছিল উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে এসে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা মার খাক!
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রলীগ একচ্ছত্র আধিপত্য চালিয়ে আসছে। তারাই ঠিক করছে কে ক্যাম্পাসে থাকবে, কে থাকবে না, কে হলে সিট পাবে, কে পাবে না। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থাকার প্রয়োজন কী?
ক্যাম্পাসে অতীতে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ হয়েছে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে। কিন্তু উপাচার্যের সঙ্গে একটি ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের সাক্ষাৎ নিয়ে এ রকম ঘৃণ্য ঘটনা ঘটতে পারে, তা ভাবতেও কষ্ট হয়।
একদা প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়কে তাঁরা কতটা নিচে নামিয়েছেন! এর আগে গত মে মাসে ছাত্রদলের কর্মসূচি বানচাল করতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা একইভাবে হামলা করেছিলেন। সেই সময় ‘উসকানিমূলক’ স্লোগান দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল। এবার তো সে রকম কিছু না ঘটলেও হামলার পুনরাবৃত্তি ঘটল।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী করে ভুলে গেছে, যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁরাও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। অতীতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও শিক্ষকেরা ছাত্রদের ন্যায়সংগত আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। একাধিক উপাচার্য সরকারের অন্যায় আদেশ না মেনে পদত্যাগও করেছেন। আর আজ তঁারা একটি ছাত্রসংগঠনের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করছেন, এর চেয়ে লজ্জার কী হতে পারে?
উপাচার্য ঘটনার কারণ জানার চেষ্টা করছেন বলে দাবি করেছেন। যাঁরা সেদিন হামলা করেছেন, তাঁদের ছবি গণমাধ্যমে এসেছে। ফলে হামলার কারণ ও হামলাকারীদের চিহ্নিত করা কঠিন নয়।
তিনি প্রক্টরের নেতৃত্বে যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন, সেই কমিটি সত্য প্রকাশে ব্রতী হবে, না সত্যকে আড়াল করবে, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে উপাচার্য আগেভাগে পরিস্থিতি জানার পরও নিজের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে পারেন না বা দেওয়ার চেষ্টা করেন না, তাঁর সে পদে থাকার নৈতিক অধিকার আছে কি না, সেই প্রশ্ন তোলা অযৌক্তিক নয়।
এ জাতীয় আরো খবর..