বকেয়া বিল পরিশোধে বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিল থেকে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এই অর্থ দিয়ে সংস্থাটি বেসরকারি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল পরিশোধ করবে। পিডিবি সূত্র জানায়, আর্থিক সংকটে বেশ কয়েক মাস ধরে তারা বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের বিল ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছিল না। ফলে পিডিবি অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে বারবার টাকা চাওয়া ছাড়াও বিভিন্ন খাত থেকে অর্থসংস্থানের চেষ্টা করছিল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিল থেকে ঋণ পেতে আবেদন করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি)।
তবে বিইআরসি তাদের আবেদনে সাড়া দেয়নি। পরে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আবারও আবেদন করা হয় তিন হাজার কোটি টাকা ঋণের জন্য। অবশেষে বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিল থেকে পিডিবিকে এ ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে।
জানা গেছে, অর্থ বিভাগ পরিস্থিতি বিবেচনা করে পিডিবির ঋণ মঞ্জুর করলেও কিছু শর্ত দিয়েছে। যার মধ্যে গুরুত্বপূর্র্ণ শর্ত হলো- অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাবদ যে টাকা পিডিবি পায়, সেখান থেকে এই অর্থ সমন্বয় করতে হবে। এ ছাড়া পিডিবি বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিল সম্পর্কিত রেগুলেটরি গাইডলাইন্স, ২০১৯ এর শর্ত অনুযায়ী ওই ঋণের অর্থ পরিশোধ করবে সার্ভিস চার্জসহ। পিডিবির এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, সাম্প্রতিক বৈশ্বিক সংকটের প্রভাবে পিডিবিও আর্থিক সংকটে পড়েছে। গত কয়েক মাসে এই সংকট আরও প্রকট হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ভর্তুকি বাবদ নিয়মিত যে টাকা পাওয়া যেত, সেটিও গত কয়েক মাস ধরে কমতে থাকে। এর মধ্যেই বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা তাদের পাওনার জন্য চাপ দিচ্ছিল। পিডিবি থেকে নিয়মিত বিল না পাওয়ার কারণে বেসরকারি খাতে তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো তেল আমদানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। ফলে পুরো সিস্টেমের ওপর প্রভাব পড়েছে। সে জন্যই বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিল থেকে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর হয়েছে। এখন এই অর্থ দিয়ে অনেক বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল পরিশোধ করা যাবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চুক্তি অনুযায়ী গত কয়েক মাস থেকে নিয়মিত বিল পরিশোধ করতে পারছে না পিডিবি। চলতি বছরের শুরু থেকেই পিডিবি তারল্য সংকটে ভুগছে। ফলে আইপিপি, রেন্টাল, কুইক-রেন্টাল এবং আমদানির বিল পরিশোধ করতে গত মাসে বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিল থেকে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ চায়।
এদিকে গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি এবং তেল সংকটে ঠিকমতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারায় লোডশেডিংয়ের মতো সংকট শুরু হয়েছে। এ ছাড়া আপাতত তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে জ্বালানি সাশ্রয়েরও চেষ্টা করছে সরকার। শিল্প কারখানাগুলোতে এলাকাভিত্তিক বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে দেওয়া হয়েছে শিডিউল। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত মাসে পিডিবি থেকে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব বরাবর একটি চিঠি দেওয়া হয়।
চিঠিতে পিডিবির সংকটের কথা তুলে ধরে বলা হয়, দেশে ক্রমবর্ধমান হারে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। বর্ধিত চাহিদা পূরণ এবং বিদ্যুৎ নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ করতে পিডিবি সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কিনে সেটি বিতরণ কোম্পানিকে সরবরাহ করে। তবে বরাবরই সেই বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় কম দামে বিক্রি করা হয়। ফলে পিডিবি বিশাল আর্থিক লোকসানের মধ্যে পড়েছে।
এদিকে সরকার ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি), রেন্টাল বা ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন মূল্য অপেক্ষা কম দামে বিক্রির ফলে যে ঘাটতি হয় তা ভর্তুকির মাধ্যমে পরিশোধ করে। কিন্তু বর্তমানে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় তরল জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হয়েছে। বিশেষ করে ডিজেল ও ফার্নেসভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ বেশি উৎপাদন করতে হচ্ছে। যার কারণে বেসরকারি মালিকরা পিডিবিকে তাদের বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে চাপ দিচ্ছে।
পিডিবি বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির বিলের আংশিক গত জুলাই মাসে এসে পরিশোধ করা হয়েছে। এখনো অপরিশোধিত রয়ে গেছে প্রায় দুই হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া চলতি বছরের মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসের বিল বাবদ আরও জমে গেছে ২৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। তার সঙ্গে ফেব্রুয়ারির অপরিশোধিত বিল যোগ করলে হয় ২৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এসব বিলের মধ্যে মার্চ মাসের বিল ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, এপ্রিলে ৬ হাজার ৬০০ কোটি, মে মাসের বিল ৬ হাজার ৩০০ কোটি এবং জুন মাসের ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। তবে মে ও জুন মাসের বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ পিডিবি রাজস্ব পেয়েছে সাত হাজার ৮৬ কোটি টাকা। হিসাব অনুযায়ী সংস্থাটির ২ ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ঘাটতির পরিমাণ ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
পিডিবি তাদের চিঠিতে আরও উল্লেখ করেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে আইপিপি, রেন্টাল বিদ্যুৎ থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়-বিক্রয় ঘাটতি বাবদ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৮ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা, যার বিপরীতে ২০২১ সালের জুলাই থেকে একই বছরের অক্টোবর পর্যন্ত মোট সাত হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি বাবদ পেয়েছে পিডিবি।