রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেলওয়ের ভূসম্পত্তি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০২০ সালে একবার সংশোধন করা হয়। দুবছরের মাথায় এখন আবার এ নীতিমালা সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। সংশোধিত নীতিমালার খসড়ায় ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প কারখানার ক্ষেত্রে বিনা দরপত্রে জমি দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। রেলের জমি ইজারা প্রদানে স্বচ্ছতা আনয়নে ভূমি মন্ত্রণালয়কে এ সংক্রান্ত কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা হয়েছিল দুবছর আগের সংশোধিত নীতিমালায়। সর্বশেষ খসড়া নীতিমালায় ভূমি মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত না রাখার কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রেল কর্তৃপক্ষের যুক্তি, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততার কারণে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হয়। ভূমি মন্ত্রণালয়কে সরিয়ে দিলে এ বিষয়ে একচ্ছত্র ক্ষমতা পাবে রেল কর্তৃপক্ষ।
বর্তমানে যারা রেলের জমি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন, তারা রেল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে ও নির্দিষ্ট ফি দিয়ে সেসব জমির বৈধতা পাবেন প্রস্তাবিত সংশোধনীতে অবৈধ দখলদারদের বৈধতা প্রদানের এ সুযোগ রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সংশোধনীতে সুযোগ রাখা হয়েছে অ্যাপার্টমেন্ট-শপিংমলসহ বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে রেলভবনে মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের সভাপতিত্বে খসড়া নীতিমালা নিয়ে একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। বৈঠকের নোটিশেও এ বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য রেলমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
রেলওয়ে মহাপরিচালক কামরুল আহসানের সঙ্গে গতকাল রাতে ফোনে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। ভূসম্পত্তি ব্যবহারের খসড়া সংশোধনী নিয়ে এ বৈঠক কি না, জানতে চাইলে তিনি শুধু বলেন, ‘এটি মন্ত্রণালয়ের বৈঠক’। এ বিষয়ে তার আর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
রেল মন্ত্রণালয় সূত্র থেকে এ বিষয়ে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তা অবশ্য এক ধরনের আশঙ্কা জাগায় যে, বিশেষ ব্যক্তিদের জমি দিতেই বিনা দরপত্রের এ সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে। ইজারার মানে হচ্ছে প্রতিযোগিতা; সর্বোচ্চ দরদাতাই দরপত্র পাবেন। বিনা দরপত্রে প্রতিযোগিতা না থাকায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হবে এমন ভাবনা রেলের মাথায় রাখা এবং এ জন্য শিল্প কারখানা স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করতে বিনা দরপত্রে জমি প্রদান উদ্দেশ্যমূলক বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভূমি নীতিমালার খসড়া সংশোধনীতে উল্লেখ করা হয়েছে ‘সরকারি/বেসরকারি/ব্যক্তি মালিকানাধীন রপ্তানিমুখী, দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে এ ধরনের শিল্প কারখানা স্থাপনের জন্য রেলওয়ের প্রস্তাব ও সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে বিনা দরপত্রে বাণিজ্যিক হারে দীর্ঘমেয়াদি লিজ প্রদান করতে পারবে রেলপথ মন্ত্রণালয়।’
উদ্দেশ্যের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে ‘পড়ে থাকা জমি দেশের উন্নয়নমূলক কাজে লাগানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং রেলের রাজস্ব আয় বাড়ানো।’ রেলসংশ্লিষ্টরা এ নিয়ে শঙ্কিত। তারা বলছেন, বিনা দরপত্রে জমি দেওয়ার সুযোগ ক্ষমতার অপব্যবহারকেই বরং উদ্বুদ্ধ করবে; এতে করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আর্থিক অনিয়মের ফাঁক রাখা হচ্ছে।
রেলওয়ের বিদ্যমান নীতিমালায় সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংস্থার কর্মকা-ে প্রয়োজনে অর্থাৎ পরিষেবামূলক কাজে ভূমি ব্যবহারের সুযোগ রাখা আছে। এতে করে যে কোনো মোবাইল কোম্পানির অপটিক্যাল ফাইবার লাইন, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন পাইপলাইন, গ্যাসলাইন, টেলিফোন লাইন, বিদ্যুৎ লাইন, বাঁধ, রাস্তা, নর্দমা ইত্যাদি স্থাপন ও নির্মাণের কথা বলা আছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমি বরাদ্দ কমিটির সুপারিশের কথা উল্লেখ করেছে রেলওয়ে।
রেলের এক কর্মকর্তা জানান, শিল্প কারখানা স্থাপনে দীর্ঘমেয়াদে জমি ইজারা দিতে পারবে রেলপথ মন্ত্রণালয়। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) রেলওয়ের জমিতে সংস্থাটির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে নির্মাণ করা যাবে অ্যাপার্টমেন্ট, হাসপাতাল, শপিংমল, অফিস ভবন। বিনা টেন্ডারে দীর্ঘমেয়াদে অর্থাৎ ৫০ বছরের জন্য জমি ইজারা দিতে পারবে রেল মন্ত্রণালয়। তা ছাড়া যারা অবৈধভাবে জমি দখল করে আছেন তাদের লাইসেন্স দিয়ে বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে।
সূত্রমতে, নীতিমালায় বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে ৪৬ ধারায়। ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে জমি দিতে এ ধারায় ‘গ’ এবং ‘ঘ’ উপধারা যুক্ত করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। নীতিমালার ২৪ ধারা সংশোধন করে অবৈধ দখলদারকে বৈধ হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে খসড়ায়। রেলের জমিতে যারা বর্তমানে আইনগত ভিত্তি ছাড়াই অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে রেখেছেন, তারা ২০ গুণ বেশি ফি দিয়ে সেসব স্থাপনার বাণিজ্যিক লাইসেন্স নিতে পারবেন। নির্ধারিত বাৎসরিক ফি দিয়ে জমি ব্যবহারও করতে পারবেন। ৩০ ধারার সংশোধনীতে প্রস্তাব করা হয়েছে, অবৈধভাবে দখল করা কৃষি জমি তিনগুণ ফি দিয়ে ইজারা নিয়ে বৈধ করা যাবে।
২০২০ সালের নীতিমালার ৪৩ ধারায় ২০(খ) এবং ২০ (গ) শ্রেণিভুক্ত জমি পিপিপির মাধ্যমে বরাদ্দের সুযোগ রাখা হয়েছিল। তবে এ নিয়ম শিথিল করে জয়েন্ট ভেঞ্চার (যৌথ উদ্যোগ) প্রস্তাব রাখা হয়েছে খসড়ায়। নীতিমালার ৬০টি ধারার ১৩টি সংশোধন করতে খসড়া করেছে রেল। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন প্রধান ব্যবসা হলেও, ‘নন-কোর বিজনেস’ হিসেবে দীর্ঘমেয়াদে জমি ভাড়া দিয়ে আয় বাড়াতে চায় বলে খসড়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছে রেল। লোকসানে ধুঁকতে থাকা রেল বর্তমানে কৃষি কাজের জন্য এক বছরের জন্য জমি ভাড়া দেয়। বাণিজ্যিক কাজে স্বল্প মেয়াদে অর্থাৎ এক থেকে তিন বছরের জন্য এবং দীর্ঘ মেয়াদে অর্থাৎ তিন থেকে বিশ বছর মেয়াদে জমি ইজারা দেওয়া হয়। নীতিমালার ৪(ট) ধারা সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। তা অনুমোদিত হলে ৫০ বছরের জন্য জমি ইজারা দেওয়া হবে। কৃষি জমি ১ বৈশাখ থেকে ৩০ চৈত্র হিসাবে ইজারা দেওয়া হয়। খসড়া সংশোধনীতে বলা হয়েছে, বাংলা সনের পরিবর্তে ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন হিসাবে ইজারা দেওয়া হবে। জানা গেছে, লাইসেন্সকৃত জমি বা জমির অংশ বিশেষ বাংলাদেশ রেলওয়ে বা সরকারের প্রয়োজন হলে তা ৩০ দিনের নোটিশের মাধ্যমে ওই ভূমির লাইসেন্স বাতিল ও ভূমির দখল গ্রহণ করা যাবে। প্রস্তাবিত খসড়ায় অবশ্য ডিজিটাল পদ্ধতি প্রয়োগে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
রেলের নীতিমালার ৫২ ধারা অনুযায়ী খোলা জমির বার্ষিক বাণিজ্যিক ফি এলাকাভেদে প্রতি বর্গ ফুটে ১৫ থেকে ১০০ টাকা; আচ্ছাদিত জমি প্রতি বর্গ ফুটে ১৮ থেকে ১৫০ টাকা। রেলের অনেক জমি গত ৫০ বছরে বেহাত হয়ে গেছে। এর পরও সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, সারাদেশে সংস্থাটির ৬১ হাজার ৮৬০ একর জমি রয়েছে। এর অর্ধেকের কিছু বেশি ৩১ হাজার ৫৬৯ একর জমি রেল ব্যবহার করছে। ১৪ হাজার ৪৭৩ একর জমি বিভিন্ন স্থানে ইজারা দেওয়া রয়েছে। ১১ হাজার ৯৭৬ একর অব্যবহত পড়ে রয়েছে। বাকি তিন হাজার ৮৪২ একর চলে গেছে অবৈধ দখলে।
নীতিমালার ২০ ধারায় রেলের জমির শ্রেণি বিন্যাস করা হয়েছে। যেসব জমি অদূর ভবিষ্যতে কাজে লাগবে সেগুলো ২০(খ) উপধারা ভুক্ত। যেগুলো সুদূর ভবিষ্যতে ভবিষ্যতে কাজে লাগবে সেগুলো ২০(গ) উপধারাভুক্ত। খসড়া সংশোধনীতে বলা হয়েছে, আগামী ১০০ বছরের উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত জমি রেখে ২০ (গ) ভুক্ত জমি দীর্ঘমেয়াদে অর্থাৎ ৫০ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া যাবে।
নীতিমালার ২৩ ধারা অনুযায়ী, বিভাগীয় শহর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় রেলের ইজিপি দরপত্রের মাধ্যমে ইজারা দেওয়া হয়। খসড়া সংশোধনীতে, উš§ুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে জমি ইজারার প্রস্তাব করা হয়েছে। লাইসেন্স গ্রহীতা ইজারা নেওয়া জমির লাগোয়া প্লট ১০ গুণ ফি বেশি দিয়ে লিজ নিতে পারবেন।