আগামী ৪ মে থেকে দেশব্যাপী উপজেলা নির্বাচন শুরু হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় সংসদসহ সব ধরনের নির্বাচন বর্জন করে আসা বিএনপি। তবে দলটির মাঠপর্র্যায়ের অনেক নেতাই এবারও দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নির্বাচনী মাঠে থাকছেন।
দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ৪ মার্চ সোমবার বগুড়ার শেরপুর উপজেলার মান্দাইল গ্রামে বিএনপির প্রয়াত নেতা আবদুল মতিনের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিলে অতীতের মতোই দল থেকে বহিষ্কার করা হবে।’
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। সেখানে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এতে দুই ধরনের মত আসে। তবে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার পক্ষের মতই বেশি। শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ বলেন, নির্বাচনে প্রার্থী হলে তাকে বারণ বা বহিষ্কারও করা হবে না এমন কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। স্থানীয় রাজনীতিতে যেহেতু সরকার পরিবর্তন হয় না, তাই তৃণমূলকে উজ্জীবিত রাখতে বিকল্প কৌশল ভেবে দেখা যেতে পারে। তবে নেতাদের কেউ কেউ পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলেন, উপজেলা নির্বাচনে দলীয় নেতাদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার ঘোষণা দিলে এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে বৈধতা দেওয়া হয়। বিএনপি যেহেতু ৭ জানুয়ারি নির্বাচন করেনি, সে কারণে উপজেলা নির্বাচনও তাদের করা উচিত হবে না। আবার সুযোগ দিলে বিভিন্ন জায়গায় একাধিক ব্যক্তিও নির্বাচনে উৎসাহী হবেন, এতে দলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। এমন বাস্তবতায় উপজেলা নির্বাচনে না যাওয়াই উচিত।
তবে বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের কেউ কেউ বর্তমান প্রেক্ষাপটে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বকে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক লাভ-ক্ষতির হিসাব আরও নিবিড়ভাবে করার পরামর্শ দেন। নির্বাচন এখনো বেশ দূরে। তাই একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ বিষয়ে চূড়ান্ত বার্তা ঘোষণা করার কথা বলেন তারা।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন ভবনের নিজ দপ্তরে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, চার ধাপে নির্বাচন হবে। তফসিল দিতে ৪০ থেকে ৪২ দিন সময় লাগে, তাই রোজার মধ্যেই তফসিল হবে। ইসি যে সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করেছে সে অনুযায়ী, প্রথম ধাপে ৪ মে ১৫৩টি, দ্বিতীয় ধাপে ১১ মে ১৬৫টি, তৃতীয় ধাপে ১৮ মে ১১১টি ও চতুর্থ ধাপে ২৫ মে ৫২টি উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দেশে বর্তমানে উপজেলা ৪৯৫টি। বাকি উপজেলাগুলোয় পর্যায়ক্রমে নির্বাচন হবে।
এর আগে গত ২২ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানায় আওয়ামী লীগ; অর্থাৎ এই নির্বাচনে কাউকে নৌকা প্রতীক দেবে না দলটি। ফলে দলের যে কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থীর মতো ভোট করতে পারবেন।
এদিকে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে মূলত সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধিরাই বেশি আগ্রহী। প্রথম ধাপের নির্বাচন অন্তত ১০ জন বিএনপির সাবেক ও বর্তমান নেতা এই নির্বাচনে মাঠে থাকছেন বলে দেশ রূপান্তর তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতীক না থাকাটাই নির্বাচনে অংশ নিতে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের প্রলুব্ধ করেছে। দলীয় প্রতীক না থাকায় ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার জোরে স্থানীয় সরকারে জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ তাদের সামনে রয়েছে। আবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ ও উপজেলার নেতাদের মধ্যে একধরনের বিভক্তির তৈরি হয়েছে। সেটা কাজে লাগিয়ে নিজেদের নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধ করা গেলে অর্ধেক উপজেলায় উপজেলা চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করার মতো সক্ষমতা এখনো বিএনপির রয়েছে। তারা বলছেন, বিএনপির মূল টার্গেট আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন, সুতরাং স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে তাতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ফলাফল কী হবে, সেটা পরের বিষয়। নির্বাচনে অংশ নিলে সারা দেশের নেতাকর্মীরা আত্মগোপন অবস্থা থেকে প্রকাশ্যে আসার সুযোগ পাবে। এতে দল চাঙ্গা হবে। আগামীতে সরকার পতনের আন্দোলনের জন্য এটি সহায়ক হবে।
২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচন বর্জনের পর উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। ওই সময় শতাধিক উপজেলায় বিএনপির প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছিলেন। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সিটি নির্বাচনে অংশ নেন কুমিল্লার মনিরুল হক সাক্কু ও নারায়ণগঞ্জের তৈমূর আলম খন্দকার। এ ছাড়া উপজেলা, পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচনেও কিছু নেতা নির্বাচন করেন। তাদের সবাইকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এবারও কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু এবং কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন কায়সার।
সারা দেশে প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে ৫০ জনের মতো বিএনপির সাবেক ও বর্তমান নেতা অংশ নিতে পারেন বলে জানা গেছে। অন্তত ১০ নেতার প্রচার চালানোর তথ্য রয়েছে দেশ রূপান্তরের কাছে।
নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি আতাউর রহমান মুকুল ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছেন নির্বাচনী প্রস্তুতি হিসেবে। তিনি দেশ রূপান্তরকে জানান, গতবার দলের সিদ্ধান্ত মেনে অংশ নেননি। দুইবার উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলেন। এবারও তিনি অংশ নিতে চান। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বৈঠকও করেছেন।
দেশ রূপান্তরের কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি কামরুল হুদা, বুড়িচং উপজেলার উপজেলা যুবদল আহ্বায়ক জাভেদ কাউসার সবুজ, ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সরদার জাহিদুল হক, দেবিদ্বার উপজেলার বিএনপি সমর্থক মার্কিন প্রবাসী জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়া নির্বাচনে অংশ নেবেন এমন আলোচনা রয়েছে।
হবিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, জেলার মাধবপুর উপজেলার তিনবারের চেয়ারম্যান (বর্তমান চেয়ারম্যান) ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ শাহজাহান, হবিগঞ্জ সদর উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও জেলা বিএনপির সদস্য মহিবুল ইসলাম শাহিন নির্বাচন করার জন্য মাঠে রয়েছেন।
এ ছাড়া নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার দুবারের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা দেলোয়ার হোসেন ভূঁইয়া দুলাল ও জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সহসভাপতি নবী নেওয়াজ খান বিপুল নির্বাচন করতে পারেন এমন আলোচনা রয়েছে। জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলায় উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব ফখরুজ্জামান মতিন নির্বাচন করবেন বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভোট আমার নাগরিক অধিকার। যেদিন ভোট দিতে পারব, সেদিনই আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব। এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ দেখি না।’