বিলুপ্তির পর ঢাকা মহানগর উত্তরের নতুন নেতৃত্ব যাচাই-বাছাই করছে বিএনপি। খুব শিগগিরই এ কমিটি দেয়া হবে বলে জানা গেছে। অন্য দিকে দক্ষিণের কমিটি অপরিবর্তিতই থাকছে। গত মঙ্গলবার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সাথে মহানগরের নেতাদের বৈঠকে দক্ষিণের নেতাদের আরো সংগঠিত হয়ে কাজ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ওই বৈঠকে সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির বিরুদ্ধে কোনো কোনো পক্ষ যে উদ্দেশ্যমূলক ‘ক্যাম্পেইন’ করছে, ভালো কাজ দিয়ে তার জবাব দেয়ারও পরামর্শ দেয়া হয়। যদি কেউ দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কাজ করে, তার সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
মহানগর উত্তরের কমিটি বিলুপ্ত করার পর ইতোমধ্যে ১১ দিন অতিবাহিত হয়েছে। কাদের নতুন কমিটিতে জায়গা দেয়া হবে, তা নিয়ে এখন বিএনপিতে নানামুখী যাচাই-বাছাই চলছে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী সপ্তাহের মধ্যে উত্তরে নতুন আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হতে পারে। দল এবং নেতাকর্মীদের কাছে যারা ক্লিন ইমেজের নেতা হিসেবে পরিচিত, তাদেরকেই নতুন কমিটিতে প্রাধান্য দেয়া হবে। বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের মহানগর উত্তরে ইতোমধ্যে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের মধ্য থেকেই নেতৃত্ব আসতে পারে। এ দিকে মহানগর উত্তর বিএনপির কমিটি ভেঙে যাওয়ায় দক্ষিণের কমিটিও বিলুপ্ত করা হতে পারে বলে নেতাকর্মীদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়। দক্ষিণ বিএনপির সাবেক নেতাদের একটি অংশ এ ব্যাপারে জোরেশোরে তৎপরতাও শুরু করেন। তবে মহানগর দক্ষিণ বিএনপির কমিটির ব্যাপারে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সন্তুষ্ট বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, রফিকুল আলম মজনু ও তানভীর আহমেদ রবিনের নেতৃত্বাধীন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির দুই সদস্যের আংশিক আহ্বায়ক কমিটি আপাতত ভাঙছে না, সেখানে কোনো পরিবর্তনও আসছে না। ইতোমধ্যে দক্ষিণের কমিটির দুই নেতার সাথে তারেক রহমান কথা বলেছেন। তাদেরকে যথেষ্ট সতর্কতার সাথে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা এবং জনসম্পৃক্ততা আরো বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন।
জানা গেছে, মহানগর উত্তরে নতুন কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে বিএনপিতে নানামুখী তৎপরতা, তদবির, জল্পনা-কল্পনা চলছে। দলের ঢাকা মহানগরকেন্দ্রিক রাজনীতিতে যারা সক্রিয়, তারা নিজ নিজ বলয় থেকে নেতৃত্ব উঠিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন তারা। একই সাথে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও তার নিজস্ব চ্যানেলে যোগ্য ও ক্লিন ইমেজের নেতৃত্বের ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছেন। বিশেষ করে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই, দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়- এমন নেতাদের নেতৃত্বে আনতে কাজ করছেন। বিএনপির দায়িত্বশীল কয়েকজন নেতা বলেন, তারেক রহমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে চান। এ বিষয়টি মাথায় রেখে সম্পূর্ণ ক্লিন ইমেজের নেতাদের দিয়ে মহানগর উত্তর বিএনপির নতুন কমিটি গঠন করতে চান তিনি। মাত্র আড়াই মাসের ব্যবধানে গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে দলের ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করে বিএনপি। এর আগে গত ৭ জুলাই সাইফুল আলম নিরবকে আহ্বায়ক ও আমিনুল হককে সদস্যসচিব করে দুই সদস্যের এই আংশিক আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা বলেছেন, লিখিত সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই দল এই ব্যবস্থা নিয়েছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশৃঙ্খলা রোধ এবং সাংগঠনিক শৃঙ্খলা রক্ষায় ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ গ্রহণ করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সারা দেশে দল ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ৩০০-এর অধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়। কয়েকটি জেলা কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির কমিটিও বিলুপ্ত করে হাইকমান্ড। দলটির একাধিক দায়িত্বশীল নেতার মতে, বিশৃঙ্খলা রোধে তারেক রহমানের এমন কঠোর অবস্থান দল ছাড়াও দেশের মানুষের কাছে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। সংগঠনকে গতিশীল এবং নেতৃত্বের বিকাশে ২০১৭ সালের এপ্রিলে ঢাকা মহানগর বিএনপিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। উত্তরে এম এ কাইয়ূমকে সভাপতি এবং আহসান উল্লাহ হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এরপর ২০২১ সালের আগস্টে আমান উল্লাহ আমানকে আহ্বায়ক ও আমিনুল হককে সদস্যসচিব করে উত্তর বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহানগর উত্তরের নতুন কমিটিতে বিদায়ী কমিটির আহ্বায়ক সাইফুল আলম নিরবের কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে বিলুপ্ত কমিটির সদস্যসচিব আমিনুল হকের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। আমিনুলের ঘনিষ্ঠদের প্রত্যাশা, নতুন কমিটির শীর্ষ দুই পদের যেকোনো একটিতে তিনি থাকবেন।
আমিনুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, মহানগর উত্তর বিএনপির রাজনীতির সাথে দীর্ঘ সময় ধরে জড়িত রয়েছি। এর আগেও সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করেছি। নেতাকর্মীদের সুখে-দুঃখে তাদের পাশে রয়েছি। সবসময়ই সততার সাথে কাজ করেছি। আগামীতেও দায়িত্ব দেয়া হলে তা শতভাগ নিষ্ঠা ও সততার সাথে পালন করব। এ ক্ষেত্রে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
নতুন নেতৃত্বের জন্য আলোচনায় আছেন মহানগরের সাবেক সভাপতি এম এ কাইয়ূম। এই নেতার সাংগঠনিক সক্ষমতা ইতোমধ্যে দলের কাছে প্রমাণিত। আওয়ামী সরকারের আমলে তাকে দেশের বাইরে নির্বাসনে থাকতে হয়েছে। সেখানে তিনি জেলও খেটেছেন। দলের সিনিয়র পর্যায়ের নেতাদের কেউ কেউ তাকে পুনরায় দায়িত্ব দেয়ার কথা বলেছেন বলে জানা গেছে।
ভালো অবস্থানে আছেন এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি ঢাকা মহানগর উত্তরে ছাত্রদল ও যুবদলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০২০ সালে ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নও পান তিনি। সেই হিসেবে উত্তরে তার একটা শক্ত অবস্থান আছে। মহানগরের নেতৃত্বের জন্য অনেকেই তাকে যোগ্য মনে করছেন। জানতে চাইলে এস এম জাহাঙ্গীর বলেন, মহানগর উত্তরের রাজনীতির সাথে তিনি দীর্ঘ সময় ধরে জড়িত রয়েছি। দল যখন যে দায়িত্ব দিয়েছে, তা শতভাগ সততার সাথে পালন করার চেষ্টা করেছি। দল যদি ঢাকা মহানগর উত্তরের নেতৃত্বের জন্য যোগ্য মনে করে, তাহলে তা আস্থার সাথে পালন করব।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক এম কফিল উদ্দিনও নেতৃত্বের আলোচনায় রয়েছেন। তিনি একাধারে ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ। তিনি উত্তরের সাধারণ সম্পাদক পদে আসতে চান। জানতে চাইলে কফিল উদ্দিন বলেন, দলের প্রয়োজনে হাইকমান্ড যখন যে দায়িত্ব দিয়েছে, তা সবসময় সততার সাথে পালন করার চেষ্টা করেছি এবং আজীবন করে যাবো। বিগত সময়ের মতো এবারো দলের শীর্ষনেতা সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন। মহানগর উত্তরে যাচাই-বাছাইয়ের তালিকায় আরো আছেন যুবদলের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি মামুন হাসান, মোস্তাফিজুর রহমান সেগুন ও আক্তার হোসেন। বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মহানগরীর নেতাদের সাথে মিটিংয়ে নতুন নেতৃত্ব নিয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন তারেক রহমান। শেষ মুহূর্তে দলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র কোনো নেতাকে দায়িত্ব দেয়া না হলে উত্তরে আমিনুল হক-এস এম জাহাঙ্গীর কমিটি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।