‘আমি অনেক বছর ধরে বিএনপির রাজনীতি করছি। আমার ছেলে ৪-৫ বছর ধরে ছাত্রলীগের রাজনীতি করছে। অতীতে বিএনপির কত মিটিং-মিছিলে গিয়েছি। রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কোনদিন ছেলের সঙ্গে আমার বাকবিতণ্ডাও হয়নি। তাহলে আমার ছেলে বিষপান করে কেন আত্মহত্যার চেষ্টা করবে? নিঃশ্চয়ই কেউ বা কোনো মহল ফায়দা লুটতে ছেলেকে চাপ সৃষ্টি করেছে।’
শুক্রবার বেলা দুইটার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ১৩ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছেলে নীরব ইমনের (২২) শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে দেশ রূপান্তরকে এসব কথা বলছিলেন ইমনের বাবা মোহাম্মদ জহির (৪৬)।
তাদের বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা ইউনিয়নের মালিরহাট এলাকায়। ইমন পোমরা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর তার বাবা মো. জহির পোমরা ইউনিয়ন যুবদলের সহসভাপতির দায়িত্বে আছেন।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পোমরা ইউনিয়নে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তাদের মধ্যে ইমনও ছিলেন। এ সময় চট্টগ্রাম নগরে অনুষ্ঠিত বিএনপির রোডমার্চ কর্মসূচিতে তার বাবার অংশ নেওয়ার একটি ছবি দেখতে পেয়ে তাকে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে লাল চিহ্ন দিয়ে পাঠান এক ছাত্রলীগ নেতা।
ছাত্রলীগ নেতা নীরব ইমন বাবার ছবিটি দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে বাড়িতে ছুটে যান এবং এ নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রাগারাগি করেন। এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বিষপান করেন তিনি। পরে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
শুক্রবার বেলা দুইটায় চমেক হাসপাতালের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে (মেডিসিন ইউনিট-১) গিয়ে দেখা যায়, একটি কেবিনের ৪২ নম্বর শয্যায় শুয়ে আছেন ইমন। বেডের সঙ্গে গামছা দিয়ে তার দুই হাত ও দুই পা বাঁধা। বুকে লাগানো আছে চিকিৎসার নানা যন্ত্রপাতি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বাম হাত দিয়ে মাঝে মাঝে নিজের মোবাইল ফোন ক্রল করছেন ইমন। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন তার বাবা ও ফুফু।
এখন কেমন আছেন এমন প্রশ্ন করলে ইমন বলেন, ‘ভাল আছি।’
ছেলে কেন বিষপান করেছে জানতে চাইলে বাবা জহির বলেন, ‘বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার দিকে ছেলে বিষপান করেছে। তখন আমি চট্টগ্রাম শহরে বিএনপির রোডমার্চ কর্মসূচিতে ছিলাম। ছেলের ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে বিএনপির রোডমার্চের কর্মসূচিতে আমার অংশ নেওয়ার যে ছবিটি তার (ইমন) বন্ধুরা তাকে ম্যাসেঞ্জারে পাঠিয়েছে সেই ছবি আমি নিজেই ফেসবুকে আপলোড করেছি। আমি দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এসব নিয়ে ছেলে কোনদিন আমার কাছে প্রশ্নও তোলেনি। এতদিন পর এসে কেন সে বিষ খেয়ে মরতে যাবে? নিঃশ্চয়ই তাকে সরকার দলীয় কোনো মহল বলেছে, “তুমি ছাত্রলীগ কর। তোমার বাবা কেন বিএনপির রাজনীতি করে।” এভাবে বলায় হয়তো সে অপমানিত বোধ করেছে। তাকে বিষ খাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার দিকে ইমন বিষপান করার আগে তার বাবা বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত থাকার বিষয়ে বাড়িতে গিয়ে পরিবারের কারও সঙ্গে রাগারাগির বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন জহির। ইমনের শারীরিক অবস্থা জানতে চাওয়া হয় ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. শ্রাবন্তীর কাছে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ইমনের পাকস্থলি ওয়াশ করা হয়েছে। সিনিয়রদের পরামর্শে তার চিকিৎসা চলছে। তবে তিনি এখন আশঙ্কামুক্ত কি না তা বলা মুশকিল। তাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।’
১৩ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বরত চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে মো. জহির জানান, ইমন এখনও আশঙ্কামুক্ত নয়।
জহির পেশায় ছিলেন অটোরিকশাচালক। তবে ৪-৫ বছর আগে সেই পেশা ছেড়ে গ্রামে অন্যের জমিজমা চাষাবাদ করে সংসার চালানো শুরু করেন। দুই মেয়ে ও চার ছেলের মধ্যে ইমন সবার বড়। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এক ছেলে কোরআনের হাফেজ। আরেক মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে।
ইমন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। বছর দেড়েক আগে ইমনকে দুবাই পাঠানো হয়েছিল। পাঁচমাস আগে সে দেশে ফিরে আসে। আগামী জানুয়ারিতে ফের দুবাই যাওয়ার কথা তার।
পরিবার সম্পর্কে এসব কথা বলার মাঝে জহির বলেন, ‘আমি বিএনপি করি বলে ছেলে বিষপান করে আত্মহত্যা করবে বিষয়টি আমাকে অবাক করেছে। এতে নিশ্চয় কারো না কারো ইন্ধন আছে।
ইমনের চাচা পোমরা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মো. মহিউদ্দিনের দাবি, জহির বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত থাকায় তার ছেলে তাকে রাজনীতি থেকে বিরত থাকতে বলত। এরপরও তার বাবা বিএনপির রোডমার্চ কর্মসূচিতে যাওয়ায় ক্ষোভে ইমন এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে জেনেছি।’