বিএনপি তাদের সমাবেশগুলোতে যতটা লোকসমাগম ঘটাচ্ছে, আওয়ামী লীগ তাদের সমাবেশগুলোতে তার চেয়েও বেশি জনসমাগম ঘটানোর চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী দল বিএনপির সমাবেশ ও পাল্টা সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিভাগীয় পর্যায়ে বিএনপি একাধিক সমাবেশ করার পর আওয়ামী লীগও ঢাকায় সমাবেশ করেছে।
বিএনপি তাদের সমাবেশেগুলোতে যতটা লোকসমাগম ঘটাচ্ছে, আওয়ামী লীগ তাদের সমাবেশগুলোতে তার চেয়েও বেশি জনসমাগম ঘটানোর চেষ্টা করছে। আগামী ডিসেম্বর মাসে বিএনপি ঢাকায় এবং আওয়ামী লীগ চট্টগ্রামে বড় ধরনের সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক সমাবেশ থেকে দলগুলো কী অর্জন করতে চায়?
‘বিএনপির গা ঝাড়া দেয়া’
বিএনপি ২০১৪ সালের একতরফা সাধারণ নির্বাচনের আগে এবং পরে রাস্তায় আন্দোলন করলেও এরপর থেকে দলটি রাজপথে কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।দলটি ২০১৮ সালের বিতর্কিত সাধারণ নির্বাচনের পরেও রাস্তায় কোন আন্দোলন করেনি। দলের মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন নেতা-কর্মীরা মনে করেন, আগামী নির্বাচন তাদের দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য রাস্তায় আন্দোলনের কোন বিকল্প দেখছে না বিএনপি। দলের বিভিন্ন সূত্র বলছে, রাস্তায় আন্দোলন চাঙ্গা করার জন্য বিভাগীয় পর্যায়ের সমাবেশগুলো তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দলটি মনে করছে, সমাবেশের মাধ্যমে লোকসমাগম ঘটনো গেলে সেটি সরকারের উপর একটি মনস্তাত্বিক চাপ তৈরি করবে।
তাছাড়া এখনকার সময়টিও গুরত্বপূর্ণ। দ্রব্যমূল্য এবং জ্বালানি তেলের ব্যাপক উর্ধ্বগতি এবং ডলার সংকটের কারণে সরকার কিছুটা চাপের মধ্যে রয়েছে।এজন্য রাস্তায় আন্দোলন শুরু করার জন্য এটি মোক্ষম সময় মনে করছে বিএনপি।বিএনপির নেতারা মনে করেন, এখন সমাবেশের মাধ্যমে রাস্তায় না নামলে পরিস্থিতি পরবর্তীতে ‘হাতছাড়া’ হয়ে যেতে পারে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ আমরা জণগণের দাবি নিয়ে সামনে এসেছি। মানুষের জীবনে এখন হাহাকার। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, বেকারত্বের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ।”
তিনি বলেন বিভাগীয় সমাবেশগুলোর মাধ্যমে বিএনপির উদ্দেশ্য দল গোছানো এবং মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নির্বাচন আসছে ১৪-১৫ মাস পরে। সুতরাং এটা তার আগে একটা ‘গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা এবং প্রতিপক্ষকে জানান দেয়া যে তারা মোটামুটি শক্তিশালী’। সেজন্য জনসমাবেশে তারা অনেক লোকজন নিয়ে আসার চেষ্টা করছে।
“এখন তারা বুঝতে পারছে যে নির্বাচন যেহেতু ঘনিয়ে আসছে সেজন্য তাদের শক্তিটা জানান দেয়া দরকার। এতোদিন তো ধরে নেয়া হতো যে বিএনপি মনে হয় পথে বসে গেছে, দলটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। সে অবস্থায় তারা দেখাচ্ছে যে তাদের শক্তি এখনো শেষ হয়ে যায়নি,” বলেন মি. আহমদ।
আওয়ামী লীগের পাল্টা সমাবেশ কেন?
বিএনপির সমাবেশগুলোর পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে আওয়ামী লীগও বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশ করছে। এসব সমাবেশের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরাও দেখিয়ে দিতে চায় যে তাদের জনসমর্থন কম নেই।
গত ২৯শে অক্টোবর ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকায় সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ।
দলটি এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে ডিসেম্বরের চার তারিখে তারা চট্টগ্রামে সমাবেশ করবে যেখানে দলটির সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ দেয়ার কথা রয়েছে। ঢাকার সমাবেশে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, চট্টগ্রাম সমাবেশে ১০ লাখ লোকের সমাবেশ হবে।
আওয়ামী লীগ নেতাদের কথায় স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, সমাবেশগুলোতে ব্যাপক লোক সমাগম ঘটানো তাদের টার্গেট। দলটি মনে করছে, বিএনপির কর্মসূচির সময়ে তারা যদি মাঠে না থাকে, তাহলে রাজনৈতিকভাবে অসুবিধায় পড়তে পারে দলটি। সেজন্য বিএনপির সাথে সাথে আওয়ামী লীগও নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বাংলাকে বলেন, সমাবেশগুলোর মাধ্যমে আওয়ামী লীগও চায় তাদের জনসমর্থন দেখাতে।“আমরা নিরব থাকলে মানুষ মনে করবে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন নেই। আওয়ামী লীগের শিকড় অনেক গভীরে। মানুষের কাছে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা আছে,” বলেন কৃষিমন্ত্রী মি. রাজ্জাক।
আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক লোকসমাগম ঘটিয়ে জনসভা করার রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সমাবেশে মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি ভোটের রাজনীতিতেও ব্যাপক প্রভাব তৈরি করে। “সমাবেশ একটা মেসেজ (বার্তা) দেয়। এগুলোকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই,” বলেন ড. রাজ্জাক। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠির মধ্যে একটা বড় অংশ এখনও গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর নির্ভরশীল নয়।
রাজনৈতিক দলগুলো জনসমাবেশে যেসব বক্তব্য দেয় সেগুলো মানুষের উপর প্রভাব ফেলে। আওয়ামী লীগ মনে করছে, তারা যদি রাস্তায় সক্রিয় না থাকে তাহলে বিএনপি সেটির সুযোগ নিয়ে দেশে ‘অস্থিরতা’ তৈরি করতে পারে। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি অংশ বলে মনে করেন বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ।
“প্রতিপক্ষের চেয়ে আমার শক্তি বেশি এটা দেখানো। রাজপথে নিজেকে যত বড় করে দেখানো যায় সেটার একটা মূল্য আছে বলে অনেকে মনে করেন।
“রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে রাজপথে শক্তির মহড়া দিলে নিজেকে মাঠে দৃশ্যমান রাখা যায়। এটা এক অদ্ভূত সংস্কৃতি আমাদের দেশে,” বলেন মি. আহমদ।
-BBC BANGLA