বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে জন-আকাক্সক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে এখন সরকারের উচিত- জাতীয় নির্বাচনের দিকে ফোকাস করা। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের আয়োজন করা হলে প্রশ্ন জাগতে পারে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতীয় নির্বাচনকে বিলম্বিত করে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে চাইছে। এমনটিই মনে করছে বিএনপি। দলটির মতে, দেশবিরোধী নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নেই। নির্বাচন যত বিলম্বে হবে, সংকটও তত বাড়বে। কাজেই যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের পথে হাঁটা উচিত সরকারের।
গত সোমবার রাতে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নীতিগতভাবে এমন অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। রাত পৌনে ৯টা থেকে পৌনে ১১টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা ব্যাপ্তির এ বৈঠকে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম, জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন, ভোটার হওয়ার বয়সসীমা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার যুক্তরাজ্য সফরসহ দেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বৈঠকে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে জন-আকাক্সক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে এখন সরকারের উচিত- জাতীয় নির্বাচনের দিকে ফোকাস করা। গত সোমবার রাজধানীতে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, জাতীয় পর্যায়ে সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হলেও ঢাকার বাইরে মানুষের মতামতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রাধান্য পাচ্ছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের মধ্যেও এ মতামত আছে। ঢাকার বাইরে মতবিনিময় করতে গিয়ে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন এ চিত্র পাচ্ছে। এর আগে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের একাধিক মতবিনিময়েও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার বিষয়ে পরামর্শ উঠে এসেছিল।
এ ইস্যুতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^রচন্দ্র রায় বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল কাজ হচ্ছে নির্বাচনকালীন সংস্কার ও জাতীয় নির্বাচনকে গুরুত্ব দেওয়া। তা যদি না করে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে ভাবে, তা হলে সরকারের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, এই সরকার জাতীয় নির্বাচনকে বিলম্বিত করে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, অবশ্যই এ সরকার তা করবে না।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেতারা বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিপক্ষে তারা। এ ধরনের সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন হওয়ার নজির নেই। সরকারের উচিত, জন-আকাক্সক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের দিকে ফোকাস করা। সরকারকে কোনো চাপ কিংবা কোনো পক্ষ বা কারোর স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে জনস্বার্থে দেশকে নির্বাচনমুখী করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিজয় দিবসে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমার ব্যাপারে একটা ধারণা দিলেও এখনও সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দেয়নি সরকার। এর পেছনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাপ থাকতে পারে বলেও বিএনপির বৈঠকে কেউ কেউ অভিমত দেন। তারা বলেন, ছাত্ররা সরকারি সহযোগিতায় নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছে। সেই দলকে সংগঠিত করা এবং সারাদেশে এর কার্যক্রম বিস্তৃত করতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। সে জন্য তারা দ্রুত নির্বাচন চায় না। তবে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে এবং জনগণের পালস বুঝে সরকারকে রোডম্যাপ দিয়ে লক্ষ্য স্থির করে সামনের দিকে এগোতে হবে। কারণ দেশবিরোধী নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় নির্বাচিত সরকারের বিকল্প নেই। তা ছাড়া নির্বাচন যত বিলম্ব হবে, সংকটও তত বাড়বে।
দেশে ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর নির্ধারণ করা উচিত বলে গত ২৭ ডিসেম্বর রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে অভিমত দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়টিতে আলোচনায় বিএনপি নেতারা অভিমত দেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশেই ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ বছর। এটি নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। ১৭ বছর নির্ধারণ করলে জটিলতা বাড়বে, নির্বাচন অনুষ্ঠানে কালক্ষেপণ হবে। সুতরাং ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ বছরই থাকা উচিত।
প্রধান উপদেষ্টার ওই বক্তব্যের পর দিন রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বলেন, ভোটারের বয়স ১৮ বছর তো আছে, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। যদি কমাতে চান, সেটি নির্বাচন কমিশন প্রস্তাব করুক। এভাবে না বলে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়টি আনা উচিত ছিল, এটি ভালো হতো। তা হলে কোনো বিতর্কের সৃষ্টি হতো না। মানুষের মনে এখন বেশি করে আশঙ্কা তৈরি হবে, এটি করতে গিয়ে আরও সময় যাবে, কালক্ষেপণ হবে। মানুষের মনে ধারণা সৃষ্টি হচ্ছেÑ কেন যেন এই সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করছে।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ নিয়েও আলোচনা হয় বৈঠকে। বিএনপির নেতারা মনে করেন, এই ঘোষণাপত্রে তাদের বিগত ১৬ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম ও ত্যাগের স্বীকৃতি থাকতে হবে। কেননা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করতে গিয়ে এই সময়ে তাদের অসংখ্য নেতাকর্মী গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, হামলা-মামলা, নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
বিএনপি নেতাদের ভাষ্য- হঠাৎ করেই নয়, বরং বিএনপির গত ১৬ বছরের আন্দোলনের পটভূমিতে জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে এবং ফ্যাসিবাদের পতন ঘটেছে। সুতরাং এই গণ-অভ্যুত্থান কেবল ৩৬ দিনের আন্দোলনের ফল নয়। কিন্তু বিএনপির সেই দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। এমন প্রেক্ষাপটে ঘোষণাপত্রে গণতন্ত্রের জন্য বিএনপির ১৬ বছরের সংগ্রাম-ত্যাগের বিষয়টি অন্তর্ভুক্তিতে সোচ্চার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। এ লক্ষ্যে শিগগিরই সভা-সেমিনারের মধ্য দিয়ে তাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন, তাদের ত্যাগের বিষয়গুলো তুলে ধরা হবে। এ ছাড়া আগামীতে সরকারের সঙ্গে আলোচনায়ও এ বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরবে বিএনপি।
গত ৩১ ডিসেম্বর ছাত্রদের ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার উদ্যোগ এবং শেষ মুহূর্তে সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক ঐকমত্যে এ ঘোষণাপত্র তৈরির ঘোষণায় তা স্থগিত করা হয়। ডিক্লারেশন প্রশ্নে ছাত্র ও সরকারের এমন অবস্থান বিএনপির কাছে স্পষ্ট নয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এই ইস্যুতে সরকার যখন আলোচনার উদ্যোগ নেবে, তখন বিষয়টি তুলে ধরবে বিএনপি।
জানা যায়, ছাত্রদের জুলাই ঘোষণাপত্রের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ’৭২-এর সংবিধানকে বাতিল করা। এ ক্ষেত্রে বিএনপির আপত্তি রয়েছে, যেটি দলটির নেতারা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন। স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে ফের আলোচনা হয়েছে। নেতারা মনে করেন, সংবিধানের বাইরে গেলে দেশে অস্থিরতা তৈরি হবে।
তা ছাড়া ছাত্ররা যে সংবিধান বাতিল করে দেওয়ার কথা বলছে, সেই ’৭২-এর সংবিধানের আলোকেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠনসহ রাষ্ট্রের সব কিছু পরিচালিত হচ্ছে। অর্থাৎ এই সংবিধানের অধীনে রাষ্ট্রের কাঠামোগত একটা অবস্থান আছে। সুতরাং যারা এটা বাতিলের কথা বলছেন, তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বিএনপির অভিমত, সংবিধান কখনও কবর দেওয়া যায় না। পরিবর্ধন, পরিমার্জন বা সংশোধন হতে পারে। সেটাই হবে সর্বোত্তম পন্থা।
বৈঠকে খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বলা হয়েছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি যে এখন বিদেশে যাচ্ছেন, এটা দলের জন্য অনেক স্বস্তির বিষয়। বৈঠকে বিএনপি চেয়ারপারসনের সুস্থতার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাওয়া হয়েছে। চিকিৎসা শেষে তিনি দ্রুত দেশে ফিরে আসবেন, এমন প্রত্যাশাও ব্যক্ত করা হয়।