সেবা, সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ভূষিত করা হয়ে থাকে রাষ্ট্রীয় দুটি পদকে। যার একটি রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) এবং আরেকটি হলো বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম)। পুলিশের চাকরিতে এসব পদক খুবই সম্মানজনক বলে বিবেচনা করা হয়। পদক পাওয়া কর্মকর্তারা আর্থিক সুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি নামের শেষে উপাধি হিসেবে এই পদক ব্যবহার করে থাকেন। গত ছয় বছরে পুলিশ বাহিনীর যেসব সদস্য এই দুটি পদক পেয়েছেন, অনিয়মের অভিযোগে তা এখন বাতিল করতে চায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পুলিশের প্রায় হাজারের কাছাকাছি সদস্য পিপিএম এবং বিপিএম পদকে ভূষিত হন। তাদের অনুকূলে পদক দুটি বাতিলে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে মন্ত্রণালয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে নিজেদের পছন্দের কর্মকর্তাদের এসব পদক দিয়েছে, যা নিয়ে পুলিশ বাহিনীতে অসন্তোষ ও নানা প্রশ্ন রয়েছে। অনিয়মের মাধ্যমে দেওয়া এসব পদক বাহিনীর একটি অংশের মনোবলে চিড় ধরিয়েছে। এখন সময় এসেছে বাহিনীর অভ্যন্তরে সৃষ্ট সেই অসন্তোষ দূর করার।
সংশ্লিষ্ট অন্য একটি সূত্র জানায়, প্রশাসন ক্যাডারেও ‘জনপ্রশাসন পদক’ নামে সম্মানজনক হিসেবে বিবেচিত একটি পুরস্কার রয়েছে। পুলিশের মতো অনিয়মের মাধ্যমে দেওয়া কিছু কর্মকর্তার জনপ্রশাসন পদকও বাতিল করার পরিকল্পনা অন্তর্বর্তী সরকারের রয়েছে। বিতর্কিত কারা এই পদক পেয়েছেন, তা যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। সব ঠিক থাকলে তাদের পদকও বাতিলের সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১৮ সাল থেকে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য পিপিএম এবং বিপিএম পদকে ভূষিত হয়েছেন, তাদের পদক বাতিল চেয়ে ফাইল চালাচালির কাজ শুরু করেছে। অবশ্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পদক বাতিল করার ক্ষেত্রে কোনো জটিলতা থেকে থাকলে তা দূর করা হবে। নতুন বছরের জানুয়ারি মাসেই পদক দুটি বাতিলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘২০১৮ সাল থেকে দেওয়া এসব পদক ত্রুটিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এগুলোতে চরম অনিয়মের আশ্রয়ও নেওয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে। তাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব পদক বাতিলের সুপারিশ করতে যাচ্ছে।’
একই মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘পুলিশকে দায়িত্বশীল করে তুলতে যে সংস্কারকাজ অন্তর্বর্তী সরকার শুরু করেছে, তাতে বিতর্কিত ও ত্রুটিযুক্ত এসব পদক বাতিল করা না হলে ফ্যাসিস্ট সরকারের সৃষ্ট ক্ষত শুকানো যাবে না।’ এই কর্মকর্তা আরও বলেন, গত বুধবার এ-সংক্রান্ত ফাইল চালাচালি শুরু হয়েছে।
শিগগিরই পুলিশের বড় এ দুটি পদক বাতিলের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে জানিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এসব পদক বাতিলে জটিলতা দূর করতে অধিকতর বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার পুলিশ বাহিনীকে ধ্বংস করেছে। তারা এসব পদক দিয়ে পুলিশকে ব্যক্তিগত রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। ফলে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে দেওয়া এ দুটি পদক বাতিল করা সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। পুলিশ সংস্কারের অংশ হিসেবে এসব পদক বাতিলের গুরুত্ব অনুভব করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পদক বাতিলে সুপারিশ করে শিগগিরই উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। ওই বৈঠকে অনুমোদন পেলে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে পদক বাতিলের এই ফাইল।’
বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যদের প্রতিবছর পিপিএম পদকে ভূষিত করা হয়। পদকের সঙ্গে আর্থিক সম্মানীও থাকে। প্রতিবছর পুলিশ সপ্তাহের বার্ষিক পুলিশ প্যারেডে সরকারপ্রধান পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের এই পদক পরিয়ে দেন। যারা এই পদকে ভূষিত হন, তাদের নামের শেষে পিপিএম (সেবা) উপাধি যুক্ত হয়। যারা একাধিকবার এই পদকে ভূষিত হন, তাদের নামের শেষে পিপিএম (বার) উপাধি যুক্ত হয়।
বিপিএম বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যদের প্রতিবছর অসীম বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দেওয়া হয়। প্রতিবছর পুলিশ সপ্তাহের বার্ষিক পুলিশ প্যারেডে সরকারপ্রধান কর্মকর্তাদের এই পদক পরিয়ে দেন। যারা এই পদকে ভূষিত হন, তাদের নামের শেষে বিপিএম উপাধি যুক্ত হয়। যারা একাধিকবার এই পদকে ভূষিত হন, তাদের নামের শেষে বিপিএম (বার) উপাধি যুক্ত হয়।
অভিযোগ উঠেছে, সরকারি দলের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত এবং বিতর্কিতরাই বিপিএম ও পিপিএম সেবা পদকে ভূষিত হয়েছেন। বহুল আলোচিত বেনজীর আহমেদ এবং হারুন অর রশীদসহ বহু বিতর্কিত কর্মকর্তার নাম রয়েছে এসব পদক পাওয়াদের তালিকায়। এমনকি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ওসি প্রদীপকেও বিপিএম-পিপিএম পদক দেওয়ার নজির রয়েছে।
কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অনেক ভালো পুলিশ সদস্যকে পদক দেওয়া হয় ঠিকই। একই সঙ্গে তদবির, টাকা ও রাজনৈতিক সুপারিশে অনেক অযোগ্য অফিসারও পুলিশ পদক পেয়ে থাকেন।
বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে সর্বোচ্চসংখ্যক ৪০০ জনকে পদক দেওয়া হয় চলতি বছর। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভূমিকা রাখায় এই পুরস্কার পান তারা। এর আগে সর্বোচ্চসংখ্যক পদক দেওয়া হয় ২০১৮ সালে। ওই বছরও পদক দেওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুলিশের ভূমিকার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়। ওই সময় ৩৪৯ জনকে পদক দেওয়া হয়।
তবে বিতর্ক থাকলেও ঢালাওভাবে পদক বাতিলের বিরোধিতা করেছেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্সের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঢালাওভাবে এ পদক বাতিলের সিদ্ধান্ত ঠিক হবে না। তাতে পুলিশের মনোবল আরও ভেঙে যাবে। এমনিতে পুলিশ বাহিনী নাজুক হয়ে পড়েছে। পিপিএম ও বিপিএম পদক যেগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া সেগুলো বাতিল করা যেতে পারে।’ যদিও পুলিশ সদস্যদের পদক দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হয়েছে বলেও স্বীকার করেন ওমর ফারুক।
তিনি বলেন, ‘সে ক্ষেত্রে বাতিলের সিদ্ধান্ত হতে পারে। কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও পেশাদারি প্রমাণ করে যারা পদক পেয়েছেন, সেগুলো বাতিল করা ঠিক হবে না।’
এ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করেন আইন মেনে, বিধিবিধান মেনে। এর ভেতরেই যারা পেশাদারি বজায় রেখে কাজ করেন, দক্ষতা-যোগ্যতাসম্পন্ন তাদের ক্ষেত্রে প্রত্যেক সেক্টরেই পুরস্কার থাকে। এটি উৎসাহব্যঞ্জক ব্যাপার। পুলিশ বাহিনীতেও তেমনি দুটি পদক দেওয়া হয়। একটি পিপিএম, অন্যটি বিপিএম। এ পদকগুলো দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু ফন্দিফিকির, তেলবাজ ও চাটুকার কর্মকর্তার খপ্পরে পড়েছে সরকার। প্রত্যেক সরকারের সময়ে এরা খপ্পরে ফেলে। ফলে দেখা গেছে অপজিশন লিডারকে (বিরোধীদলীয় নেতা) ঘুসি মেরেছে, এজন্য পদক দেওয়া হয়েছে বা আদায় করে নেওয়া হয়েছে। তবে আমি যখন পুলিশপ্রধান ছিলাম, তখন এগুলো কম হতে দিয়েছি।’
সাবেক পুলিশপ্রধান আরও বলেন, ‘যারা সাহসিকতা, পেশাদারি ও যোগ্যতা দেখাতে পেরেছেন, তারা বঞ্চিত হয়েছেন। অযোগ্যরা এ পদক বারবার পেয়েছেন।’
পদক বাতিলের উদ্যোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনির মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করেও কোনো সাড়া মেলেনি।