মিয়ানমার সীমান্ত থেকে প্রতিনিয়ত শোনা যাচ্ছে গুলির শব্দ। এ কারণে ঘুমধুম, নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ও দৌছড়ি এই ৩ ইউনিয়নের বাসিন্দারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন পার করছে।
একেকটি দিন যাচ্ছে আর পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়ানক হয়ে উঠছে। গুলির শব্দে সেখানে দেখা দিয়েছে ব্যাপক আতঙ্ক। ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।
সীমান্তের ওপারে প্রবল গোলাবর্ষণের কারণে ঘুমধুমের তুমব্রু এলাকা থমথমে হয়ে পড়েছে। ভয়ে-আতঙ্কে স্থানীয়রা কেউ ঘরের বাইরে বেরোচ্ছেন না। এই সংঘাত মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ হলেও কখনো কখনো সেখান থেকে ছোড়া গুলি ও মর্টার শেল নাইক্ষ্যংছড়িতে স্থানীয়দের ঘরবাড়ি ও ধানী জমিতে এসে পড়েছে।
সীমান্তের কাছাকাছি এলাকা জুড়ে হেলিকপ্টার টহল দিচ্ছে। যার কারণে এলাকাবাসীর মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রবল হচ্ছে। বাড়ি থেকে কেউ বাইরে বের হতে পারছে না।
নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তবাসীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান মো: জাহাঙ্গীর আজিজ।
১১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা সোলতান আহমেদ বলেন, মংডু বুচিডং ও রচিডং এলাকায় আমার আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। তাদের মারফতে জানতে পারি ওখানে উগ্রপন্থী মগ ও সেখানকার সরকারি লোকজন এসে স্বর্ণালঙ্কারসহ টাকা লুটে নেয়। যাওয়ার সময় ১৮ জন রোহিঙ্গা নারীকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে। এতে বাধা দিলে পাঁচজন পুরুষকে তারা হত্যা করে। এই পর্যন্ত ৮০ জনের মতো মুসলমানকে এরা হত্যা করেছে বলে আমাদের কাছে খবর এসেছে। এদের মধ্যে বড় বড় আলেমও রয়েছেন।
উখিয়া বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কথা হয় আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মাস্টার মোহাম্মদ জোবাইরের সাথে। তিনি বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী মগ এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠী তারা পরিকল্পিতভাবে মুসলিম পাড়ায় আক্রমণ করছে। মুসলমানদের হত্যা, ধর্ষণ ও চরমভাবে নির্যাতন চালাচ্ছে। আমাদের প্রশ্ন তারা তো মগ পাড়ায় যায় না লড়াই করতে। মিয়ানমার আমাদেরকে একবার গণহত্যা চালিয়ে দেশ ছাড়া করেছে। ২০১৭ সালে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আমরা বাঁচাতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় গ্রহণ করি।
কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, মিয়ানমারের মংডু ও আকিয়াব শহরের আশপাশের গ্রামে এখনো চার-পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা আছে। বিদ্রোহীদের সাথে সংঘর্ষের পর সেখানে জান্তা বাহিনী বোমা বর্ষণ ও নির্যাতন করছে। এতে আশি জনেরও বেশি মুসলমান হতাহত হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা অনেকেই গ্রাম ছেড়ে পাহাড়ে আশ্রয় দেয়ার খবর আসছে।
এদিকে পরিস্থিতি যাচাই করতে গত বুধবার দুপুরে তুমব্রু সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন বান্দরবান জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন ও বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন। পরিদর্শনকালে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার সীমান্তবাসী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে মতবিনিময় করেন।
জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, ‘সীমান্তে শান্তি রক্ষায় নিয়োজিত সব বাহিনী সজাগ রয়েছে। পরিস্থিতি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক রয়েছে। পরিস্থিতির অবনতি হলে বিপদজনক এলাকায় বসবাসকারীদের প্রয়োজনে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হবে। আতঙ্কিত হবেন না, সজাগ থাকুন।’
এ সময় এসএসসি পরীক্ষার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র। পরিস্থিতি খারাপ হলে অবস্থা বুঝে বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন বলেন, ‘সীমান্তে গত কয়েকদিন ধরে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্ক আছে। পুলিশি (নিরাপত্তা) ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়েছে ও জোরদার করা হয়েছে। ঘুমধুম সীমান্ত এলাকায় মর্টার শেলের শব্দ শোনা গেছে। এলাকার লোকজনের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আইন-শৃঙ্খলা (পরিস্থিতি) স্বাভাবিক আছে। জনগণকে নিরাপদ রাখার সব ধরনের প্রস্তুতি আমরা নিয়েছি।’
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জান্তা বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে থেমে থেমে সশস্ত্র যুদ্ধ চলছে। তাদের এই প্রত্যক্ষ যুদ্ধে গুলির শব্দ ও বিভিন্ন সময় ছুড়ে দেয়া গোলা ও মর্টার শেল নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তবর্তী লোকালয়ে এসে পড়ছে। এতে প্রতিদিনের কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠাতেও ভয় পাচ্ছেন অভিভাবকরা।
সর্বশেষ গত দু’দিন কোনার পাড়া এলাকায় বিস্ফোরিত মর্টার শেলের খোসা ও একই এলাকায় মিয়ানমার থেকে নিক্ষিপ্ত অবিস্ফোরিত মর্টার শেল এসে পড়ে। এই নিয়ে স্থানীয়দের জনমনে চরম আতঙ্ক তৈরি হলেও হতাহতের খবর আসেনি।
স্থানীয় একটি অনলাইন পোর্টালের সংবাদকর্মী মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘দুপুরের দিকে মর্টার শেল পড়ে। বিকট শব্দে চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তখন ছোটাছুটি করতে থাকে এলাকাবাসী।’
সীমান্ত লাগোয়া ভাজাবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি নুরজাহান বেগম বলেন, ‘মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে কয়েকদিন পর পর গোলাগুলি ও ভারী গোলাবর্ষণের শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। কখন গোলাগুলি শুরু হয় তা বলা মুশকিল। এমন পরিস্থিতিতে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে খুবই ভয় লাগে।’
তুইঙ্গাঝিরির বাসিন্দা অংচাইগ্য বলেন, ‘সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান যুদ্ধে ভারী গোলা বিস্ফোরণের শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। মধ্যরাতে গোলাগুলি শুরু হলে তখন ভয়ে সীমান্ত সড়কে আশ্রয় নিতে হয় আমাদের।’
জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মিয়ানমার থেকে ছুড়ে দেয়া ১৭-১৮টি মর্টার শেল পাওয়া গেছে।
বিপাকে কৃষকরা, ভাটা পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্যেও
মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একের পর এক গোলা এসে পড়ায় চরম বিপাকে রয়েছেন কৃষকরা। আতঙ্কে-আশঙ্কায় চাষাবাদ করতে পারছেন না তারা। একইসাথে ভাটা পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্যেও। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
৩৪ বিজিবির অধিনায়ক জোন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য অনুপ্রবেশ ঘিরে সতর্ক অবস্থানে আছে বিজিবি। সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। একজন রোহিঙ্গাকেও (আর) প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। আমরা সবসময় সজাগ আছি।’
নাইক্ষ্যংছড়ির ইউএনও মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, ‘সীমান্তের কাছাকাছি মিয়ানমারের ওপারে গোলাগুলি হচ্ছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ঘটনা। রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য অনুপ্রবেশ নিয়ে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।