হলিউড থেকে ২০১৭ সালে শুরু হওয়া হ্যাশট্যাগ মি-টু আন্দোলন শুরুর পরপরই এক ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকাসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে।
সমাজে ক্ষমতাবান এবং প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিদের হাতে কর্মক্ষেত্রে বা অন্য যেকোনো জায়গায় যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়ার ঘটনা যা বছরের পর বছর চেপে রাখা হয়েছিল, তা প্রকাশ করাই ছিল এই আন্দোলনের মূল ব্যাপার।
পৃথিবীজুড়ে নারীদের মধ্যে মি-টু এতটাই সাড়া ফেলে যে পশ্চিমা সমাজ থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়ার রক্ষণশীল সমাজেও বহু বছর চেপে রাখা নিপীড়নের গল্প একে একে উঠে আসে।
যৌন নিগ্রহের অভিযোগ ওঠে বহু বিখ্যাত মানুষ-প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, নামজাদা শিল্পী এমন অনেকের বিরুদ্ধে।
পাঁচ বছর পর মি-টু জোয়ারের তোড় কমেছে। কিন্তু মি-টু’র নানাভাবে প্রভাব ফেলেছে দেশে দেশে।
বাংলাদেশে কেমন ছিল মি-টু আন্দোলন?
যুক্তরাষ্ট্রে হ্যাশট্যাগ মি-টু আন্দোলন শুরুর পুরো এক বছর পর অর্থাৎ ২০১৮ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে প্রথম মি-টু অভিযোগ ওঠে।
বিদেশে বসবাসকারী দু’জন বাংলাদেশী নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করে ফেসবুক পোস্ট দেয়ার পর এ নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়। সেটাকেই বাংলাদেশে মি-টু আন্দোলনের শুরু বলা হয়।
২০১৮ সালের শেষের দিকেই দেশের ভেতরে নানাভাবে যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়ার আরো বেশ কয়েকটি ঘটনা আলোচনায় উঠে আসে।
শুরুর দিকের অভিযোগগুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা, গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখি হয়। সে সময় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে তদন্তের কথা বলা হয় এবং নারী অধিকারকর্মীরাও সে সময় বেশকিছু কর্মসূচি নেন।
কিন্তু এরপর কয়েক বছর পার হয়ে গেলেও সেইসব অভিযোগের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? কিংবা আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে আলোচনা নেই।
বাংলাদেশে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন মানুষেরা মনে করেন, বাংলাদেশে মি-টু তেমন আলোড়ন বা সাড়া জাগাতে পারেনি।
বাংলাদেশে কেন জোরালো আলোড়ন তৈরি করতে পারেনি মি-টু?
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তামান্না সুলতানা। তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে তার ছদ্মনাম ব্যবহার করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, মূলত মি-টু আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১৯ সালে ফেসবুকে পোস্ট দেন। সেখানে তিনি শৈশবে তার নিজের ওপর ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির কথা প্রকাশ করেন। নিজের একজন প্রভাবশালী আত্মীয়ের কাছে যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছিলেন তিনি।
ঘটনা প্রকাশের পর তামান্না যেহেতু আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করেননি ফলে কোনো মামলা হয়নি। কিন্তু তিনি আশা করেছিলেন, অন্তত ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াবে তার পরিবার এবং চেনা মানুষেরা। কিন্তু ঘটনা হয়েছিল একেবারে বিপরীত।
তিনি বলেন, পরিবারের লোকেরা তাকেই দোষারোপ করেছিল। কেন তিনি ওই লোকের কাছে গিয়েছিলেন, কেন তিনি গোপন রেখেছিলেন ঘটনা এবং অতো ছোটবেলার কথা হলেই তার ঠিক ঠিক মনে আছে কিনা অর্থাৎ তিনি সত্যি কথা বলছেন কিনা।
তামান্না আক্ষেপ করে বলেন, ‘মি-টু মাধ্যমে যৌন নিগ্রহ বন্ধ হবে কি, আমি উল্টো পরিবার এবং চেনা মানুষের মধ্যে নানা ধরনের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হয়েছি। আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলা হয়েছে এবং আমাকে এক্সটেন্ডেড পরিবারের মানুষেরা এক রকম বয়কট করেন।’
নারী আন্দোলনকর্মীরা বলেন, বাংলাদেশে মি-টু আন্দোলন সফল না হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।
ব্যক্তিগত আক্রমণে কোণঠাসা
নারী অধিকারকর্মী খুশী কবির বলেন, বাংলাদেশে যারাই মি-টু ক্যাম্পেইনে অংশ নিয়ে নিজেদের ওপর ঘটা নিপীড়নের ঘটনা প্রকাশ করেছেন, তাদের প্রায় প্রত্যেকে নানাভাবে অপবাদের শিকার হয়েছেন। তাদের নিয়ে বিদ্রূপ করা হয়েছে।
তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাদের একেবারে কোণঠাসা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘প্রভাবশালী বা যারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে যারা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রকাশ্যে আনাটা ছিল মি-টুর প্রধান ব্যাপার। কিন্তু বাংলাদেশে যারাই অভিযোগ করেছে তাদের নানাভাবে হেনস্তা করে কোণঠাসা করা হয়েছে। সেই কারণেই পরে অনেকে নিজের নিপীড়নের কথা প্রকাশ করতে আগ্রহী হননি।’
তাছাড়া যারা অভিযোগ তুলেছেন, তারা অনেকেই মানহানি বা অনলাইন-অফলাইনে ট্রলের শিকার হন। সেটি সহ্য করার ক্ষমতাও সবার থাকে না। যে কারণে পিছিয়ে গেছেন অনেকে।
ব্যবস্থা নেয়ার নজির দেখা যায়নি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন মনে করেন, যেসব অভিযোগ উঠেছিল তার কোনো একটিরও যদি ব্যবস্থা নেয়ার দৃষ্টান্ত দেখা যেত অর্থাৎ কোনো আইনি ব্যবস্থার নজির দেখা যেত তাহলে সেটি অন্যদের উৎসাহিত করত।
যেমন হলিউডের প্রযোজক হার্ভি ওয়েনস্টেইনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর তার মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিকে বিচারের মুখোমুখি করার নজির যুক্তরাষ্ট্রে দেখা গেছে।
তিনি এখনো বন্দি জীবন-যাপন করছেন। কিন্তু বাংলাদেশে তেমনটা দেখা যায়নি।
সমাজের রক্ষণশীলতা
অধ্যাপক কাবেরী গায়েন বলেন, বাংলাদেশের সমাজ এখনো অনেক রক্ষণশীল এবং পিতৃতান্ত্রিক। ফলে নিপীড়নের ঘটনা ঘটলে এখনো বেশিরভাগই সেটি প্রকাশ্যে আলোচনা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। এছাড়া রক্ষণশীল সমাজে সাধারণত নারী নিজের ওপর ঘটনা নিগ্রহের বাইরে প্রকাশ করে বিচার চাইবে এটা অনেকে মেনে নেন না।
ফলে মি-টুতে নারীদের করা অভিযোগকে সমাজে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়নি। যার প্রভাবে এই আন্দোলন জোরালো হতে পারেনি।
এছাড়া মি-টু মিডিয়ার যথেষ্ট সমর্থন পায়নি বলেও মনে করেন অনেকে।
দুর্বল নারী সংগঠন
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশে নারী সংগঠন শক্তিশালী না হওয়ার কারণে মি-টু আন্দোলন সফল হয়নি বা সমাজে বড় চাপ তৈরি করতে পারেনি।
খুশী কবির মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে বা ভারতে মি-টু আন্দোলনের যে ফল দেখা গেছে তার পেছনে ওই দেশগুলোর নারী সংগঠনগুলো ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু বাংলাদেশে সেটি জোরালো ছিল না।
ইতিবাচক প্রভাবও আছে
তবে মি-টু ক্যাম্পেইনের এক ধরনের ইতিবাচক প্রভাবও দেখা গেছে বাংলাদেশে। মি-টু আন্দোলনের আরেকটা বিষয়টা ছিল মেয়েরা যেন সাহস করে বলতে পারে, সেটা এখন অনেকেই বলছেন।
খুশী কবির মনে করেন, নারীরা বিশেষত শিক্ষিত নারীদের মধ্যে এখন নিজের সাথে ঘটা যৌন সহিংসতার ঘটনা লুকিয়ে না রেখে প্রকাশের প্রবণতা বেড়েছে। এছাড়া কর্মক্ষেত্রে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন বা যৌন সহিংসতার নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।
পাঁচ বছর আগে কর্মক্ষেত্রে যেসব আচরণ সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য ভাবা হতো বা সহনীয় ভাবা হতো সেটি এখন দেখা যায় না। পুলিশের কাছেও আগের চাইতে বেশি নারী অভিযোগ জানাতে যান। কিন্তু আনুষ্ঠানিক অভিযোগ বা মামলা করার ক্ষেত্রে এখনো রাজি হন না নারীরা।
পুলিশের সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের কর্মকর্তারা বলেন, কেবল সরাসরি যৌন হয়রানি নয় সাইবার হয়রানির শিকার হয়েও নারীদের অভিযোগ জানানোর হার বেড়েছে।
সূত্র : বিবিসি