বরিশাল কৃষি অঞ্চলে ১৭ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষে ৩ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ লক্ষ্য অতিক্রম করে বাড়তি ১% জমিতে আবাদ সম্পন্ন করেছেন কৃষি যোদ্ধাগন। ফলে দক্ষিণাঞ্চলে দানাদার খাদ্য উৎপাদন প্রায় ৫০ লাখ টনে উন্নীত হবার ব্যাপারে আশাবাদী কৃষি বিভাগ। সমাপ্ত প্রায় রবি মৌসুমের কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর-ডিএই চুড়ান্ত হিসেবে ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৬৮০ হেক্টর আবাদ লক্ষ্যমাত্রার বিপরিতে দক্ষিণাঞ্চলে ৩.৭০ লাখ হেক্টরে আবাদ সম্পন্নের কথা বলা হয়েছে।
তবে ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে এবার বোরো ধানের উৎপাদন ব্যায় প্রায় ৮শ টাকায় পৌছবে বরে জানিয়েছেন দক্ষিণাঞ্চরেল কৃষকগন। এখনো দক্ষিণাঞ্চলে আবাদকৃত ৩.৭০ লাখ হেক্টরের অন্তত ৭৫ ভাগ জমির সেচ ব্যবস্থাই ডিজেল চালিত পাম্পের ওপরও নির্ভরশীল। ২০০২ সাল থেকে সেচকাজে ব্যবহৃত বিদ্যুতের মূল্যের ওপর সরকবার ভতর্’কি দিলেও ডিজেলের ক্ষেত্রে তা অনুপস্থিত। ফলে সারা দেশের তুলনায় দক্ষিণাঞ্চলে বোরো আবাদ ব্যায় অন্তত ২৫ ভাগ বেশী।
তবে এর পরেও ১০ লক্ষাধিক টন খাদ্য উদ্বৃত্ত দক্ষিণাঞ্চলে রবি মৌসুমে ১৭ লাখ টন বোরো চাল উৎপাদন লক্ষ্য অতিক্রমের ব্যপারে আশাবাদী কৃষিবীদগন। ইতোপূর্বে বীজতলা তৈরীর লক্ষ্য অতিক্রম করলেও পৌষের শুরু থেকে তাপমাত্রা অব্যাহত ভাবে স্বাভাবিকের নিচে নেমে যাবার সাথে ঘন কুয়াশায় ‘কোল্ড ইনজুরী’তে ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছেন কৃষকগন। তবে কোন বৈরী আবহাওয়ায় দমে থাকেননি তারা । ডিএই’র দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, এবার শীতে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের নিচে নেমে যাবার সাথে আগেভাগে শীত বিদায় সহ মাঘের মধ্যভাগ থেকে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের ওপরে উঠে যাওয়ায় পরিবেশগত কিছু সমস্যা তৈরী হয়। তবে সব প্রতিকুলতার মধ্যেও দক্ষিণাঞ্চলে বোরো আবাদ পরবর্তি পরিচর্জায় কৃষিযোদ্ধাগন দিনভর মাঠেই রয়েছেন।
এমনকি দক্ষিনাঞ্চলে হাইব্রীড ও উচ্চ ফলনশীল বোরো ধানের আবাদও বিগত বছরগুরোর তুলনায় এবার অনেক বেশী। ফলে উৎপাদনও বাড়বে বলে আশাবাদী ডিএই। সমাপ্তপ্রায় বোরো মৌসুমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলে আবাদকৃত ৩ লাখ ৭০ হাজার হেক্টরের মধ্যে প্রায় দেড় লাখ হেক্টরে হাইব্রীড জাতের ধান আবাদ হয়েছে। এর বাইরে উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান আবাদের পরিমান ২ লাখ ১৭ হাজার ২৬ হেক্টরে। আর স্থানীয় সনাতন জাতের বোরো আবাদের পরিমান ৪ হাজার ৭৬৬ হেক্টর। হাইব্রীড জাতের ধানের আবাদ বৃদ্ধিকে কৃষিবীদগন অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক এবং খাদ্য উদ্বৃত্ত দক্ষিনাঞ্চলের খাদ্য পরিস্থিতির জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক বলেও মনে করছেন।
এবার রবি মৌসুমে দেশে ৪৯ লাখ ৭৭ হাজার ৬৬০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষমাত্রা অতিক্রম হয়েছে ইতোমধ্যে। ফলে বড় কোন বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি না হলে চলতি মৌসুমে দেশে বোরো থেকে ২ কোটি ১০ লাখ টন চাল উৎপাদন লক্ষ্য অতিক্রম করার ব্যাপারে দৃড় আশাবাদী ডিএই’র দায়িত্বশীল মহল।
সমাপ্ত প্রায় রবি মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলের ১১ জেলায় বোরো ধান থেকে প্রায় ১৭ লাখ টন চাল পাবার লক্ষ্য স্থির করে ৩ লাখ ৬৮ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্য স্থির করেছে কৃষি মন্ত্রনালয়। বিগত খরিপ-২ মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলে ৮ লাখ ৫৭ হাজার ১৩৮ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ লক্ষ্য অর্জিত হয়। ফলে এ অঞ্চলে প্রায় ২০ লাখ ৫৬ হাজার টন চাল উৎপাদন লক্ষমাত্রাও অতিক্রম করেছে বলে মনে করছে ডিএই’র দায়িত্বশীল মহল। বিগত খরিপ-১ মৌসুমেও এ অঞ্চলে আবাদকৃত আউশ ধান থেকে প্রায় ৬ লাখ টন চাল পাওয়া গেছে।
তবে প্রতি বছরই দক্ষিণাঞ্চলে খরিপ-১, খরিপ-২ ও রবি মৌসুমে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াশ’,‘অশণি’ ও ‘সিত্রাং’এর মত ভয়াবহ প্রকৃতিক দূর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াই করেই ধান সহ সব ফসল করতে গিয়ে ক্লান্ত কৃষি যোদ্ধাদের। একের এপর এক প্রকৃতিক দূর্যোগ কৃষকদের ক্ষতির সাথে দুশ্চিন্তাকে বৃদ্ধি করলেও বরিশাল কৃষি অঞ্চলে এবার ৩টি মৌসুমে দানাদার খাদ্য ফসল উৎপাদন ৫০ লাখ টন অতিক্রমের ব্যপারেও আশাবাদী কৃষি মন্ত্রনালয়।
এবার শীত মৌসুম শুরুর আগেই তাপমাত্রার পারদ স্বাভাবিকের প্রায় ৪ ডিগ্রী নিচে, প্রায় ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াসে নেমে যায়। দেশের বিভিন্ন এলাকার সাথে বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলাও মৃদু থেকে মাঝারী শৈত্য প্রবাহের কবলে পড়ে ৩ দফায়। মাঘের শুরুতে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের ২-৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস নিচে নেমে যাবার সাথে উত্তর-পশ্চিমের হীমেল হওয়ায় বোরো বীজতলা ‘কেল্ড ইনজুরির’ ঝুকির কবলে পড়লেও মধ্য মাঘ থেকে শীত উধাও হয়ে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের ওপরে উঠে যায়। এমনকি পৌষের শুরু থেকে মাঘের প্রথমভাগে হাড় কাঁপান শীতে কৃষক ও কৃষি শ্রমিকরা মাঠে নামতে পারেনি।
প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে আউশ ও আমনের সফলতার পরে বরিশাল কৃষি অঞ্চলের ১১ জেলার কৃষি যোদ্ধাগন আরো প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ টন বোরো চাল পাবার লক্ষ্যে নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছেন। বরিশাল,পটুয়াখালী,ভোলা,মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরের বিস্তির্ণ এলাকা সরেজমিনে ঘুরে কৃষি যোদ্ধাদের অবিরাম ব্যস্ততা লক্ষ্য করা গেছে। এখন আবাদ পরবর্তি পরিচর্জায় ব্যস্ত কৃষকগন। গত কয়েকদিনে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় কয়েক দফায় হালকা থেকে মাঝারী বর্ষণ বোরো ধানের জন্য যথেষ্ঠ উপকারী হলেও ভারী বর্ষণ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলেও সতর্ক কৃষকরা।
বিগত প্রায় ৩টি বছরের করোনা মহামারী সংকটে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কৃষি যোদ্ধাগনই মূখ্য ভ’মিকা পালন করেন বলে স্বীকার করছেন অর্থনতির শিক্ষকগনও। তাদের মতে, ‘একের পর এক প্রকৃতিক দূর্যোগ আর করোনা মহামারী সারা দেশের মত দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতিতে যে বিরূপ পরিস্থিতি তৈরী করে, তা থেকে উত্তরনে কৃষক ও কৃষির ভ’মিকা ছিল অপরিসীম। আর কৃষিনির্ভর দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতিকে সচল রাখতে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে কৃষিযোদ্ধারাই। বিগত খরিপ-১ ও ২ মৌসুম সহ চলতি রবি মৌসুমে আউশ,আমন,বোরো, গম, ডাল,তেলবীজ ও তরমুজ সহ বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি উৎপাদনে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি যোদ্ধাগনই।
তবে ১০ লাক্ষাধিক টন খাদ্য উদ্বৃত্ত দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতি যথেষ্ঠ শক্ত অবস্থানে থাকলেও তা এখনো প্রায় পুরোটাই প্রকৃতি নির্ভর বলেই মনে করছেন কৃষিবীদগনও। বোরো আবাদ লক্ষমাত্রা অতিক্রম করায় বড় কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ না ঘটলে দক্ষিণাঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন বেড়ে উদ্বৃত্তের পরিমান ১১ লাখ টনের কাছে পৌছবে বলেও আশাবাদী মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদগন।
যুগের পর যুগ ধরে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করেই দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি,কৃষক ও কৃষি অর্থনতিকে টিকে থাকার সংগ্রামে কৃষি ব্যবস্থাপনাকে আরো আধুনিক এবং যুগোপযোগী করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন কৃষি অর্থনীতিবীদগন। এক্ষেত্রে ধান গবেষনা ইনস্টিটিউট, কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট এবং কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর’কে কৃষকদের সাথে আরো নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন সহ আধুনিক প্রযুক্তি হস্তান্তরের তাগিদ দিয়েছেন কৃষিবীদগনও।