দরিদ্র পরিবারের মেধাবী সন্তান লিটনকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল তাদের। অনেক কষ্ট করে হলেও লেখাপড়া করিয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কিন্তু সেই ছেলে কীভাবে পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো এত বড় একটি ঘটনায় জড়িয়ে পড়ল, সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না তার স্বজনরা।
দেশজুড়ে আলোচিত এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে যে ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ তাদের মধ্যে রয়েছেন লিটন সরকারও। এই খবরে তার বরিশালের বাড়িতে স্বজনদের মাথার ওপর হঠাৎ যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে।
লিটনের মা লীলা সরকার বলেন, ‘দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে ছোট ছেলেটা প্রতিবন্ধী। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। বড় ছেলেকে (লিটন) বদলা দিয়া পড়ালেহা করাইছি। এহন কী করমু, হে মুই কইতে পারি না।’
লিটনের বাবা নির্মল সরকার বলেন, ‘মাঝেমধ্যে কাম কইররা যা পাইছি, ছেলেরে দিয়েছি। ৫ লাখ টাহার জমি বিক্রি কইরা ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করছি।
হ্যাতে হয় নাই। তিনডা গরু বেইচ্যা, লোনের টাকা দিয়া পড়াইছি। খরচের ঠেলায় বেতাল হইয়া পড়ছি। তয় বাবা বইলা কই না, গ্রামের সকলের কাছে জানেন- আমার ছেলে খারাপ না।
লিটনের চাচি মধু সরকার বলেন, তাদের ২৪ কড়া (এক কড়ায় দুই শতাংশ) জমি পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করে লিটনকে দেওয়া হয়েছে। স্বপ্ন ছিল সে চাকরি করবে।
ভাই বইনরে দেখবে। কিন্তু ও করল ডা কী। শয়তান-বদমাইশ পোলা না। কীসের মধ্যে পড়ছে, কোন শয়তানের মধ্যে পড়ছে। ও আস্তে কথা কইত, কারও সাথে বেশি কথা কইত না। ওরে কীসে ফালাইছে কইতে পারি না। ওরে হয় কোনো একটা লালসা দেহাইছে, নয় একটা হুমকি-ধমকি দিছে।
মধু সরকার জানান, এসএসসি পাস করার পর বাড়ি ছেড়েছে লিটন। বেশি একটা বাড়ি আসত না। পাঁচ মাস আগে বিয়ের জন্য এসেছিল। বউ নিয়ে এখনও বাড়ি আসেনি জানিয়ে মধু সরকার বলেন, যে ঘর আছে ওই ঘরে তো বউ নিয়া থাকা যাইবে না। তাই একটা নতুন ঘরেরও কাজ শুরু করা হয়েছিল। টাকার অভাবে কাজ অল্প একটু করা হয়েছে।
লিটনের মা বলেন, লিটনের পড়াশোনার জন্য একটি পিতলের হাঁড়ি, পাঁচটি কলস, একটি ঘট, পিতলের সিন্ধুক একটা ও থালা বিক্রি করে টাকা দেওয়া হয়েছে।
লিটনের আরেক চাচি শিল্পী সরকার জানান, বরিশাল নগরীর অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয় থেকে জিপিএ ৪.৯১ পেয়ে এইচএসসি পাস করে। এর পর ঢাকার ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্সে ভর্তি হয়।
তিনি আরও বলেন, লিটনের বাবা ও দুই চাচা কাঠমিস্ত্রির কাজ করে। জমি, গরু বিক্রি করে ১০-১২ লাখ টাকা ঋণ দেনা করে পড়াশোনা করিয়েছে।
লেখাপড়া শেষ হয়েছে। কোনো চাকরিতে যাইতে পারে নাই। মাঝেমধ্যে বলত চাচি টাকা পাঠাও চলতে পারি না। বলেছি, বাবা এখন তাড়াতাড়ি চাকরি করো। দেনা তো শোধ করতে হবে। জায়গাজমি কিছু নেই। সবকিছু খুয়াইয়া ছেলেরে মানুষ করছি। কিন্যা খাইতে হয়।
লিটনের চাচা সুনীল সরকার বলেন, আমি ও লিটনের বাবা জায়গা এবং তিনটি গরু বিক্রি করে তার পড়ার টাকা দিছি। অগ্রিম টাকা এনে পড়ার খরচ দিয়েছি। কাজ করে সেই টাকা পরিশোধ করেছি।
চাচি নমিতা সরকার বলেন, এই গ্রামবাসী সবাইকে জিজ্ঞাসা করেন ওই কেমন। ওরে কেউ থাবর (চড়) মারলেও ও কোনো দিন কইত নাÑ ভাই আমারে কেন থাবর দেছেন। কী অইছে, কোনোভাবে অইছে সেইডা আমরা বাড়ি বইয়া কেমনে জানমু।
লিটনের স্ত্রী সুস্মিতার বাড়ি পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার রাখালতলা বলে জানিয়ে নমিতা বলেন, একসঙ্গে পাস করে বেরিয়েছে। মেয়ে দুই এক মাস হইছে কোথায় জানি চাকরি করে।
নমিতার দাবি, লিটনকে হয় হুমকি দিয়ে নয়তো প্রচুর টাকার লোভ দেখানো হয়ে থাকতে পারে। প্রতিবেশী খোকন সরকার বলেন, লিটন এলাকায় ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিত। স্কুলে যখন পড়ত তখন দেখা হতো। এখন বাড়ি একটু কম আসে। ওদের কোনো সম্পদ নেই। ঢাকার ব্যাপার আমরা জানি না।
আগৈলঝাড়া উপজেলার রতনপুর ইউপির ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বিধান রায় বলেন, লিটনের অভিভাবকরা এ বিষয়ে তাকে কিছু বলেনি। কিন্তু রাস্তায় আলোচনা থেকে শুনেছেন বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন কম্পিউটারের মাধ্যমে ফাঁস করার ঘটনায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও শুনেছেন যে, লিটন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তবে তাকে তিনি চিনতেন না।