বাংলাদেশের অনেক ছোট ব্যবসায়ী বা খামার মালিক অভিযোগ করছেন, বড় বড় কোম্পানির কারণে তারা ব্যবসায় টিকতে পারছেন না। প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ, প্রযুক্তি এবং ব্যাংকিং সুবিধার কারণে বড় কোম্পানিগুলো ব্যবসায় বাড়তি সুবিধা ও সরকারি আনুকূল্য পেয়ে থাকে।
ফলে ছোট ব্যবসায়ীদের অনেককেই ক্ষতির মুখোমুখি হয়ে ব্যবসা থেকেও সরে দাঁড়াতে হচ্ছে।
তবে বৃহৎ কোম্পানিগুলো বলছে, অন্যায় কোনো পন্থা না নিয়ে তারা স্বাভাবিক নিয়মেই ব্যবসা করছেন, যেমনটা সারাবিশ্বে চলছে।
বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সুষম প্রতিযোগিতার সরকারি নীতির অভাবেই এ ধরনের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
বাজার কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে?
দিনাজপুরের একজন মিল মালিক শহিদুর রহমান পাটোয়ারি বলছেন, ‘বড় বড় কোম্পানিগুলো একই সাথে প্রোডাকশন, প্যাকেজিং আর কনজুমার লেভেলে সেল করা- তিনটা সুবিধা একসাথে পেয়ে যায়। ফলে ব্যবসায় তারা অনেকটা এগিয়ে থাকে। কিন্তু ছোট কোম্পানিগুলোর পক্ষে সেটা সম্ভব হয় না। কিন্তু মুক্তবাজারের কারণে আপনি তো কাউকে নিষেধও করতে পারবেন না।’
চালকল মালিকরা বলছেন, গত দুই বছর ধরে বড় বড় কোম্পানিগুলোর সাথে কৃষকদের আগে থেকেই চুক্তি করা থাকে। ফলে কৃষকদের কাছ থেকে তারা বেশিরভাগ ধান কিনে নেয়।
বড় মিলগুলো একসাথে অনেক বেশি চাল কেনে বলে তাদের উৎপাদন খরচ কমে যায়, ফলে তারা বিক্রিও করতে পারে কমে। কিছুটা কম দামে বিক্রি করার পরেও তাদের লাভ বেশি হয়। কিন্তু ছোট মিল মালিকদের খরচ বেশি পড়ে। অথচ বিক্রি করতে গেলে তাদের বাজারের দামেই বিক্রি করতে হয়, ফলে অনেক সময় তারা লোকসানের মুখোমুখি হয়।
আবার বড় বড় মিল বা চাতাল মালিকরা সহজেই ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ পান। বিশেষ করে ধানের মৌসুমে তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অনেক বেশি ধান কিনতে পারেন। কিন্তু ছোট মিল মালিকদের সেই সুবিধা দিতে চায় না বেশিরভাগ ব্যাংক।
শহিদুর রহমান পাটোয়ারি আশঙ্কা করছেন, অসম প্রতিযোগিতায় এই ব্যবসায়ীরা বেশি দিন টিকে থাকতে না পারবে না। এক সময় হারিয়ে যাবে এবং বড় বড় কোম্পানির কাছে বাজারটা একতরফা হয়ে যাবে।
তিনি মনে করেন, যারা বড় আকারে ব্যবসা করতে পারছে না তাদের জন্য সরকারের একটা দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত। এজন্য তাদের কর হার কমিয়ে দেয়া, ব্যাংক ঋণে বিশেষ সুবিধা দেয়া, ব্যাংক ঋণের সুদহার কমানো যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
তবে বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের একজন নেতা লায়েক আলী বলছেন, ‘এটা সত্যি যে বড় বড় কোম্পানিগুলো যেভাবে ব্যবসা করে, নানারকম সুবিধা পায়, সেটা ছোট মিল মালিকরা পান না। কিন্তু বড় কোম্পানিগুলো অন্যায় কিছু করছে না, তারাও দেশের আইন মেনেই ব্যবসা করছে। এখন মার্কেটিংয়ের যে রীতি, তাতে এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই।’
তিনি বলেন, ‘পুঁজির স্বল্পতা, যোগাযোগের অভাব আর যথাযথ দক্ষতা না থাকায় কোনো কোনো ছোট প্রতিষ্ঠান হয়তো ব্যবসায় ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারে। সমস্যা হলো, ছোট ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দিতে সরকারের বিশেষ কোন নীতিমালা নেই। এরকম নীতিমালা না হলে সুষম প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি হবে না।’
একই রকম চিত্র দেখা গেছে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও। বিশেষ করে বড় কোম্পানিগুলো আমদানির ক্ষেত্রে যেসব সুবিধা পেয়ে থাকে, ছোট কোম্পানি সেগুলো পায় না।
রমজানকে সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় সাতটি পণ্য আমদানি করা নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশের বণিক সমিতির সাথে সরকারের কর্মকর্তাদের যে বৈঠক হয়েছে, সেখানে বেশ কয়েকজন ছোট আমদানিকারক সমান সুবিধা পাওয়ার দাবি জানান।
ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন ব্যবসায়ী নেতা বলেছেন, অনুমতি পেলেও এই ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক সময়ে পণ্য আনতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
বিশেষ করে ডলার সঙ্কটের কারণে বড় প্রতিষ্ঠান যেখানে এলসি খুলতে হিমশিম খাচ্ছে, তাতে এসব কোম্পানি অনুমতি পেলেও রমজানের আগে নিশ্চিতভাবে পণ্য আনতে পারবে কি না, তা নিয়ে ব্যবসায়ী নেতারাই নিশ্চিত নন।
বাংলাদেশের একটি বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপের উপদেষ্টা শাফিউর রহমান বলছেন, ‘প্রতিযোগিতা তো সবার মধ্যেই আছে। বড় বড় কোম্পানিগুলোর মধ্যেও তো ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা থাকে, তাই বলে বৈরিতা তো আর নেই। তবে অনেক দিন ধরে ব্যবসা করার কারণে বড় কোম্পানিগুলোর সাথে ব্যাংকের যেরকম সম্পর্ক থাকে, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ থাকে, অনেক ছোট ছোট কোম্পানির সেটা থাকে না। আবার বড় প্রতিষ্ঠানগুলো একইসাথে অনেক পণ্য আমদানি করে বলে তারা কম মার্জিনে পণ্য বিক্রি করতে পারে, ছোট কোম্পানিগুলোর জন্য সেই ঝুঁকি বেশি হয়ে যায়।’
এজন্য তিনি বরং ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের যোগাযোগ, ব্যাংকের সাথে সখ্যতা এবং নিশ্চিত বিনিয়োগ জোরদার করার জন্য পরামর্শ দেন।
এমনকি বাংলাদেশের ব্রয়লার মুরগির খামারিরা অভিযোগ করেছেন, মুরগি পালন এবং সেগুলো বিক্রির ক্ষেত্রে বড় কোম্পানিগুলোর কাছে তারা অসহায় হয়ে পড়েছেন।
তাদের অভিযোগ- উৎপাদন খরচে ব্যাপক পার্থক্য থাকার কারণে বড় কোম্পানিগুলোর সাথে বাজারে টিকতে পারছে না প্রান্তিক খামারিরা। ফলে অনেক প্রান্তিক খামারি তাদের খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। আর এর ফলে ব্রয়রলার মুরগির বাজারটা বড় কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। বাজারে দাম নির্ধারণে এসব কোম্পানির বড় ভূমিকা রয়েছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান সোমবার বিবিসির মুন্নী আক্তারকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘যেহেতু জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা বেশি, টেকনোলজিও আছে, ওই কারণে এই বাজারটা অনেকটাই তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে এবং সে কারণে প্রান্তিক যে চাষিরা আছে, তারা তাদের সাথে কম্পেটেটিভনেস হারাচ্ছে।’
এ কারণে অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের হিসাবে বাংলাদেশে প্রায় দেড় লাখের মতো প্রান্তিক খামারি ছিলেন যারা ব্রয়রলার মুরগি পালন করতেন। বড় কোম্পানির কাছে বাজার হারিয়ে বর্তমানে এই সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানাচ্ছে সংস্থাটি।
কেন এই অবস্থা?
বাজার পর্যবেক্ষক এবং ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সমিতির নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত এক দশকে বাংলাদেশে সরাসরি ভোক্তাদের কাছে পণ্য বাজারজাত করতে শুরু করেছে বড় বড় কোম্পানিগুলো।
আগে চাল, চাল, তেল, মসলা, মুরগি, মাংস ইত্যাদি খুচরা বা খোলাবাজারে বিক্রি করা হলেও এখন বড় বড় কোম্পানি এসব খাতে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে।
দৃষ্টিনন্দন প্যাকেজে এবং সহজে পাওয়ার কারণে, অনলাইন এবং সুপারশপ কেন্দ্রিক কেনাকাটার প্রবণতা গড়ে ওঠায় বাংলাদেশের সাধারণ ক্রেতারাও এখন এসব পণ্যের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছেন। এসব কোম্পানির মার্কেটিং নীতি ও প্রচারের কারণে এ জাতীয় পণ্যের জনপ্রিয়তাও বাড়ছে।
এর ফলে একদিকে যেমন পণ্যের দাম বেড়েছে, তেমনি ঝুঁকির মুখে পড়েছে স্থানীয় ছোট ব্যবসায়ীরা।
ঢাকার ধানমণ্ডির বাসিন্দা শিখা রহমান বলছেন, ‘আগে দোকান থেকেই চাল, ডাল কেজি হিসাবে মেপে নিয়ে আসতাম। কিন্তু প্যাকেটের চাল, ডাল একটু ভালো হওয়ায় এখন আর বাসার কেউ সেসব চাল খেতে চায় না। আমার সংসারের খরচও বেড়ে যাচ্ছে।’
অন্যদিকে মুরগি ব্যবসায়ী সুমন হাওলাদার অভিযোগ করেছেন, বড় বড় কোম্পানিগুলোর কারণে বাজারে ব্রয়রলার মুরগির দাম বেড়েই চলেছে।
ব্রয়রলারের ডিম ও মুরগির প্রায় ৮০ ভাগ উৎপাদন করে প্রান্তিক খামারিরা। তারপরও বাজারের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই বলে অভিযোগ করে খামারিদের এই সংগঠন।
তিনি বলেন, ‘তারা মাত্র ২০ ভাগ উৎপাদন করে। তথাপি তারাই বাজারটা নিয়ন্ত্রণ করেন, এটাই বাস্তবতা। তারা দাম বাড়িয়ে দিলে বাজারে দাম বাড়ে, আর কমিয়ে দিলে দাম কমে।’
ছোট ব্যবসায়ীদের তাহলে কী হবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বায়নের যুগে কখনো বড় কোম্পানিকে বাধা দিয়ে রাখা যাবে না। ক্রেতাদেরও ভোগ্যপণ্য ব্যবহারের মানসিকতায় পরিবর্তন আসছে। এক্ষেত্রে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে প্রতিযোগিতা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে, ছোট ছোট কোম্পানিগুলো কিভাবে আরো বেশি সক্ষম হয়ে উঠতে পারে, সেদিকে মনোযোগ দেয়া দরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের চেয়ারম্যান মো: মিজানুর রহমান বলছেন, ‘বিশ্বায়নের এই যুগে প্রতিযোগিতা যত বেশি হবে, যারা দুর্বল বা অদক্ষ, তাদের মার্কেট থেকে এক সময় বেরিয়ে যেতে হবে। যারা টিকে থাকবে, তাদের দক্ষতা বাড়াতে প্রযুক্তি সক্ষমতা বাড়াতে হবে, তারাই জায়ান্টদের সাথে প্রতিযোগিতা করে মার্কেটে টিকে থাকবে। সাময়িকভাবে এটা খারাপ মনে হলেও, লং টার্মে ইকোনমির জন্য ভালো।’
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের সব দেশেই বাজারজাতকরণে এই ব্যবস্থা রয়েছে। অনেক দেশে দেখা যায়, ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো স্বল্প বিনিয়োগ বা স্বল্প কর্মী নিয়ে বড় কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতায় না গিয়ে বরং অনেক সময় সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসাবে অবস্থান তৈরি করে।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, বাংলাদেশেও কোনো কোনো কোম্পানি বিশ্বের বড় বড় কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতা করে যাচ্ছে। এক সময় রেফ্রিজারেটরের মার্কেট বিদেশী কোম্পানির দখলে থাকলেও এখন বাংলাদেশী কোম্পানি এটার বড় অংশ দখল করে নিয়েছে। ফলে দক্ষতা ও প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা বাড়িয়ে ছোট কোম্পানিও ভালো অবস্থান তৈরি করতে পারে।
মিজানুর রহমান বলছেন, ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষায় সরকারের একটা নীতিমালা থাকতে হবে। হয়তো সাময়িকভাবে সাবসিডি দিয়ে টিকিয়ে রাখা যায়, কিন্তু এক সময় তাদের সরাসরি প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে।
সূত্র : বিবিসি