প্রবাস জীবন আকর্ষণীয় হলেও পেছনে থাকে অন্যকিছু। কেউ হয়তো কর্মজীবনের কিছু সময়ের জন্য প্রবাসী হন, আবার কেউ সারা জীবন কাটাতে। এ জীবন কারো জন্য সুখের, কারো জন্য দুঃখের। দেশ থেকে মানুষ বিদেশ যায় দেশের মানুষগুলোকে ভালো ও আনন্দে রাখার জন্য। দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর ক্ষেত্রেও প্রবাসীদের ভূমিকা কম নয়।
প্রবাসের কর্মজীবিরা মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তানকে ভালো রাখার জন্যই রাত-দিন পরিশ্রম করে থাকেন। তাই প্রবাসের জীবন একটু ভিন্ন। প্রবাসের চলমান জীবন ও সম্পর্কের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন- জাগো নিউজ মালয়েশিয়া প্রতিনিধি আহমাদুল কবির।
প্রবাস জীবন
দেশ থেকে যারা বিদেশ যান আমরা তাকে প্রবাসী বলি। কেননা তারা আপন জায়গা ফেলে একটু ভালো থাকার জন্য পরবাসে চলে যান। কেন যান? আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের অভাব বলে, বিদেশের মতো সুযোগ-সুবিধা নেই বলে, বেতন কম বলে ইত্যাদি কারণে। এই কারণগুলোও থাকত না, আমরা যদি আমাদের দেশের ভেতরের, দেশের মানুষদের জন্য যদি সঠিক উপায়ে সুষ্ঠু কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি করতে পারতাম। এ নিয়ে আসলে একার পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়, কাজ করতে হবে সরকারকেও।
দেশ থেকে প্রবাসে গিয়ে কি খুব ভালো থাকে কেউ? না, দেশ থেকে সবকিছু ছেড়ে যেমন তার মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজনদের রেখে যখন প্রবাসে একা একটা মানুষ যায় বা কাজ করে তখন তার মনটা কিন্তু পড়ে থাকে দেশের মাটিতেই। মনে পড়ে তার মা-বাবার কথা, ভাই-বোনের কথা, স্ত্রী-সন্তানের কথা। তখন তার আর কাজ করতে ইচ্ছে হয় না।
ইচ্ছে হয় সবকিছু ছেড়ে দিয়ে পুনরায় দেশে চলে আসতে। কিন্তু না, সময় এবং পরিস্থিতি তা করতে দেয় না, কেননা সে যদি বিদেশ থেকে দেশে এসে পড়ে তবে তার আপন মানুষগুলো অর্থকষ্টে ভুগবে, তিনবেলার খাবার একবেলা খেতে হবে, কোনো কোনো বেলা আবার না খেয়েই থাকতে হবে। এটা তার চোখের সামনে ঘটলে সে সহ্য করতে পারবে না।
তাই শত যন্ত্রণার পরও দেশের মানুষটি প্রবাসে থাকে তার কষ্ট হলেও যাতে তার প্রিয় মানুষগুলো একটু ভালো থাকে, একটু স্বস্তিতে থাকে, একটু সুন্দর থাকে, সে যেন পরবর্তীতে দেশে ফিরে সে মানুষগুলোর হাসিমুখ দেখতে পারে। আহা, তার কাছে তখনই পরম শান্তি বলে মনে হয়। মনে হয় এই মুহূর্তটার জন্যই তো দেশের বাইরে থাকা, খানিক কষ্ট করা।
আব্দুল মালেক (২৯) টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার সুজামুরি গ্রামের মো. মুচারবের ছেলে ২০০৭ সালের কলিং ভিসায় অ্যালমুনিয়াম কোম্পানিতে মালয়েশিয় আসেন। দীর্ঘদিন কাজ করেন কোম্পানিতে। ৩ বছর পর আর ভিসা করেনি কোম্পানি বাধ্য হয়ে কোম্পানি থেকে ফেরারি হন। পরে রি-হিয়ারিং এর আওতায় বৈধতা লাভ করেন কিছুদিন হলো। কাজ করেন মুরগী কাটার দোকানে। মাসে বেতন পান ১২ শ রিংগিত তা দিয়ে চলে না।
পার্ট টাইম কাজ করেন পুত্রাযায়া একটি কাপড়ের দোকানে সেখান থেকে আসে আরো এক হাজার রিংগিত। সর্বমোট মাস শেষে ২২শ রিংগিত পান। সেখান থেকে নিজের খরচের টাকা রেখে বাকি টাকা দেশে পাঠিয়ে দেন। ইচ্ছে করলেও নিজের আরাম আয়েশ ছেড়ে বীরদর্পে কাজ করে চলেছেন আব্দুল মালেক। কারন দেশে দুটি জমজ মেয়ে সন্তান চিনহা/চিন্তা, স্ত্রী, মা-বাবা রয়েছেন। তাদেরকে সুখে শান্তিতে রাখতে এই কষ্ট। আবদুল মালেকের মতো হাজারো আবদুল মালেক মালয়েশিয়ায় কাজ করে যাচ্ছেন।
আমরা আসলে জানি না একটা দেশের ছেলে অন্য আরেকটা দেশের মাটিতে কেমন কষ্ট করে আয়-উপার্জন করে। এই বিষয়গুলো আমাদের জানারও তেমন বিষয় নয়, কেন নয়? এই বিষয়গুলো জানা কি আমাদের দরকার নয়। নাকি এই বিষয়গুলো পাথর চাপা দেয়ার মতো কোনো বিষয়। না, দেশে থেকে একটা মানুষ বুকে কতটা কষ্ট নিয়ে দেশের বাইরে যায় তা হয়তো যে মানুষটা যায় সে মানুষটার থেকে ভালো আর কেউ বলতে পারবে না বা জানে না।
কেননা দেশ থেকে একটা মানুষ সুস্থ অবস্থায় বিদেশে গেল ঠিকই সে মানুষটা বিদেশ থেকে অসুস্থ অবস্থায় ফিরে আসে দেশে। তখন তার প্রিয়গুলোর কষ্ট হয় কিন্তু প্রিয় মানুষ ছাড়া বাইরের কোনো মানুষের কষ্টের লেশমাত্র হয় না। কেননা সে মানুষটা তো শুধু তার আপন মানুষগুলোর জন্যই কষ্ট করছে। তা ভুল। সে মানুষটা কষ্ট করছে একটি দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, দেশের সতেরো কোটি জীবনের জন্য, জীবনগুলোর বেঁচে থাকার জন্য।
তাহলে আমরা কেন প্রবাসে থাকা মানুষটাকে কোনো মূল্যায়ন করছি না বা সম্মান দেখাচ্ছি না বা শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটাও হারিয়ে ফেলেছি তা কেন। তা আমাদের সমাজব্যবস্থা, আমাদের দেশ এবং দেশের মানুষের কাছে প্রবাসীদের ছোট করে রেখেছে তার কারণ রাজনৈতিক ইস্যু। এই ইস্যু দ্বারা দেশের প্রত্যেকটা মানুষ বিভক্ত হলেও প্রবাসীরা কিন্তু কখনোই বিভক্ত হওয়ার কথা চিন্তা করে না। কারণ তারা বোঝে যে, দেশটা তো আমার, দেশের মানুষগুলো তো আমার, দেশের মানুষগুলোর এই সুখ-দুঃখ এগুলোও তো আমার। তাহলে কেন দেশ থেকে বিভক্ত হতে যাব। এই বিভক্ত হওয়ার জন্য তো আমাদের প্রবাসে আসা নয়, এই বিভক্ত হওয়ার জন্য তো আমাদের এই রাত-দিন পরিশ্রম করে যাওয়া নয়।
এই বিভক্তের পেছনে লুকিয়ে আছে একটা স্বার্থ। যে স্বার্থটা আসলে দেশের মানুষ বুঝলেও প্রবাসীরা তা বোঝে না, তাদের একটাই চিন্তা যে, আমার দেশের মানুষগুলোকে আমারই ভালো রাখতে হবে। আমরা আসলে টের পাই না বা বুঝতে পারি না আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রবাসীদের ভূমিকা কতটুকু। প্রবাসীরা এখানে কতটুকু দায়িত্ব পালন করছে বা কি করে যাচ্ছে। তা আমরা দেখতে পাই গুটিকয়েক মানুষের কথা চিন্তা করলে যেমন মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান যে মানুষগুলোর জন্য একজন মানুষ আসলে বিদেশে যায়। আমাদের বুঝতে একটু কষ্ট হয় যে প্রবাসীরা বিদেশ গেলে কেন দেশে আসে না বা দেশে আসার কথা চিন্তা করে না, না করার কারণ তারা দেশে ফিরলে তাদের আপন মানুষগুলোর যে সুখটা আছে বিদেশ থাকাবস্থায়।
তাদের সে সুখ থাকবে না দেশে ফিরলে। তাদের জন্যই ওদের বিদেশ থাকা, দেশে না ফেরা। দেশের সঙ্গে, দেশের মানুষজনদের সঙ্গে প্রবাসীদের সম্পর্কের কথা চিন্তা করলে আমরা দেখতে পাই দেশের প্রতি, দেশের মানুষজনদের প্রতি প্রবাসীদের যে টান-সে টান দেশের মানুষদের নেই। কেননা তারা তাদের কাছে থাকা মাতৃভূমিকে অনুভব করতে পারছে না যেমনটা পারে দেশের বাইরে থাকা প্রবাসীরা। দেশের মাটির গন্ধ পর্যন্তও তারা শুকতে পায় কেননা তাদের কাজের মধ্যে থাকে দেশকে উদ্দেশ্য করে খেটে খাওয়া মানুষদের কথা, আপন মানুষগুলোর হাসিমুখের জন্য অপেক্ষা এবং তার আরো কাছের যেমন স্ত্রী-সন্তান তাদের ভালো থাকার কথা।
সন্তানের পড়াশোনার খরচ, বৃদ্ধ মা-বাবার ওষুধের খরচ সবকিছুর কথাই যেন তার মাথায় কেউ গেঁথে রেখেছে যে, তোমার টাকার জন্য তোমার সন্তান স্কুলের বেতন দিতে পারছে না, তোমার বৃদ্ধ মা-বাবা ওষুধ কিনতে পারছে না এই কথাগুলো যেন তার কানে বাজতেই থাকে। যার জন্য সে তার কাজ ছাড়াও বাড়তি কাজ করে যেন তারা হতাশ না হয় বা যত টাকা খরচ করে ঋণ নিয়ে সে বিদেশ এসেছে তা পরিশোধ করার আগ পর্যন্ত তার যেন কোনো নিদ্রা নেই। সে কাজ করতেই থাকে তার মতো করে। সেই কাজ করার মধ্য দিয়েই মনে পড়ে দেশের কথা, দেশের মানুষজনদের কথা, আরো মনে পড়ে চেনা পরিচিত কিংবা অচেনা অপরিচিত দেশের পথ-ঘাটের কথা।
নাড়ির টান ও দেশাত্মবোধ
প্রবাসে থাকা একজন মানুষের সবচেয়ে বড় যে টান তা হলো নাড়ির টান। এই টানের কারণেই একজন প্রবাসীকে দেশ নিয়ে ভাবায়, ভাবায় তাকে ভালো কিছু নিয়ে তার দেশের কাছে, তার নাড়ির কাছে ফিরতে হবে। নইলে তার প্রবাস জীবন ব্যর্থ। এই ব্যর্থতার কারণে কেউ কেউ দেশ ত্যাগই করে না, জীবন পর্যন্ত ত্যাগ করে। এটা আসলে একটা হতাশার কারণ। এই কারণের মূল ব্যাখ্যা পাওয়া না গেলেও বোঝা যায় একটা মানুষের দেশ, দেশের মানুষ নিয়ে তার কতটা টান, কতটা বন্ধন মিশে আছে।
যে মানুষগুলো দেশে থাকে বা দেশে আছে তারা সাধারণত নাড়ির টানটা গাঢ়ভাবে অনুভব করতে পারে না। কেননা তারা দেশ দেখতে পাচ্ছে, দেশের মানুষ দেখতে পাচ্ছে, আরো দেখতে পাচ্ছে মা, ইচ্ছে করলেই ক্লান্তি এলেই তারা তাদের মায়ের আঁচল পেতে জীবনের সব ক্লান্তি দূর করতে পারছে নিমিষেই। হতাশ লাগলেও মা সেই হতাশা দূর করারও চেষ্টা করছে। আহ এর থেকে প্রশান্তির আর কী হতে পারে। কিছুই না। আসলে মা হলো সন্তানের মূল চাবিকাঠি।
মা এক পৃথিবীর সন্তানদের জন্য তার আঁচল বিছিয়ে রেখেছেন তারা তাদের ক্লান্তির সময়টুকুতে এসে আশ্রয় নেবে বলে। মা, এই মায়ের মধ্যে যেমন মমতাবোধ আছে বা কাজ করে ঠিক তেমনই মমতা আছে বা কাজ করে দেশের মধ্যে। যে দেশ কিনা প্রবাসীদের আবার তার কাছে, তার আঁচলে ফিরিয়ে আনে, শুধুই আনে না, গভীর মমতাবোধের জায়গাটুকু দিয়ে পরম যত্নে লালন করে তাদের মানুষের মতো মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার ক্ষমতা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে।
নাড়ির টানে প্রবাসে গিয়েও শান্তি পায় না বা প্রশান্তির জায়গা খুঁজে পায় না বা পেলেও তারা তার তৃপ্তিটুকু পায় না। এই পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মেলাতে গিয়ে তারা তাদের নাড়ির কাছে হার মেনে যায়, ফিরে আসে, দিনশেষে নাড়ির কাছে হাত পেতে বলে, আমাকে তোমার আঁচল দিয়ে খানিক আশ্রয় দাও, যে আশ্রয়ে কোনো ভয় নেই, গ্লানি নেই, আছে শুধু তৃপ্তি আর প্রশান্তি।
একটা মানুষের ভেতরে দেশ নিয়ে বোধ জাগে তখনই যখন সে দেশের কথা ভাবে, দেশ নিয়ে ভালো কিছু চিন্তা করে, দেশের জন্য নিজের শান্তি বিসর্জন দিয়ে কষ্ট বেছে নিয়েও প্রবাসে থাকে। দেশের ভেতরে নিজেকে খুঁজে পায় কিংবা নিজের ভেতরে দেশকে খুঁজে পায়। যে খুঁজে পাওয়ার মধ্যেও থাকে গাঢ়-গভীর মমতাবোধ। যে মমতাবোধের টানে কেউ দেশে ফিরে আসে। দেশের মানুষ দেশ ছেড়ে কি আর বিদেশ শান্তি পায়। নিজের দেশে যতটা স্বাধীনতা নিয়ে চলাফেরা করা যায়, যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাওয়া যায় সেটা কি আর অন্যদেশে সম্ভব?
বা সম্ভব হলেও সম্ভবপর তৃপ্তিটুকু মনে আসে না বা এলেও নিজের কাছে ভালো লাগে না। ভালোলাগার তৃপ্তি পূর্ণ হয়ে গেলেও না। তার একটাই কারণ বিদেশে যা কিছুই করুক না কেন প্রবাসীরা তাদের শুধু একটা কথাই মনে হয় যে, এই দেশটা তো আমার না! কিন্তু তবুও সেদেশে নিজের দেশকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য, নিজের দেশকে বিশ্বের দরবারে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য সে দেশের কাজ, সে দেশের সংস্কৃতি নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। আহারে কী নিঃস্বার্থ এগিয়ে যাওয়া।
প্রবাসীরা যদি এমনভাবে এগিয়ে না যেত তাহলে আমাদের দেশ এখন যে পরিচিত পেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তখন এটাও পেত না। এই পাওয়ার অবদান পুরোটাই প্রবাসীদের। যে প্রবাসীরা কিনা রাত কী দিন না ঘুমিয়ে দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা মাথায় রেখে এগিয়ে যাচ্ছে সে প্রবাসীদের মূল্য দেশে যেমন থাকা উচিত তেমনই দেশের বাইরেও থাকা উচিত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বড় হতাশার বিষয় তাদের কোনো মূল্য, তাদের কোনো সম্মান আমাদের দেশে নেই।
যেখানে কিনা প্রবাসীরা তার নিজের দেশেই অবহেলিত সেখানে কী করে তারা অন্যের দেশে সম্মান পাবে তা নিয়ে যদি আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা একটু ভাবতেন তাহলে হয়তো একটা না একটা সুরাহা হতো। ফলে প্রবাসীরা তাদের কাজ করার জায়গাটা নতুন করে খুঁজে পেত বা তাদের বিস্তৃতি আরো বিশাল, তাদের পরিধিটা আরো বড় হয়ে যেত। কেননা তারা মাথা গুঁজে দাঁড়ানোর মতো একটা সাপোর্ট পেত।
প্রবাসীদের সুখ-দুঃখ
প্রবাসীদের সুখ-দুঃখের কথা যদি বলি তবে আমি বলব তাদের কোনো সুখ নেই বরং দুঃখেরও কোনো শেষ নেই। কেননা তারা না ঘুমিয়ে, সময়মতো না খেয়ে, ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তবে তারাও সুখের কাঙাল। তারাও সুখ চায়। আর তারা তখনই সুখ পায় যখন কিনা তারা প্রবাস থেকে নিজের দেশে কিছু নিয়ে আসে বা প্রিয় মানুষদের হাতে তুলে দিতে পারে তাদের কষ্টের টাকা। তারা তখন আনন্দ পায়, সুখে আত্মহারা হয়ে ওঠে। তাদের কাছে তখন মনে হয় তাদের প্রবাস জীবন সার্থক। সার্থক হয়ে উঠবারই কথা, তারা যে কারণে দেশ ছেড়ে প্রবাসে গিয়ে কষ্টের জীবন বেছে নিয়েছে সে জীবনের যে মূল কথা ছিল তাদের বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা, স্ত্রী-সন্তানের জন্য ভালোভাবে জীবন কাটানোর জন্য কিছু সময় নিয়ে আসা এটাই যেন তাদের কাছে বড় পাওয়া বলে মনে হয়।
কেননা তারা তো এটার জন্যও বিদেশে দেশ ছেড়ে। প্রবাসে কী কেউ সুখের জন্য যায়? না প্রবাসে কেউ নিজের সুখের জন্য যায় না বরং অন্যের সুখটা দেখার জন্য প্রবাসে যায় দেশ ছেড়ে। তারা তাদের অর্জিত কাঙ্খিত সম্পদ দিয়ে যখন প্রিয় মানুষগুলোর জন্য প্রিয় কিছু নিয়ে আসে তখন তাদের ভালো লাগে বরং আনন্দ হয় যখন কিনা তারা বুঝতে পারে, দেখতে পারে তাদের প্রিয় মানুষ, কাছের মানুষের আনন্দ তখন তারা রীতিমতো অবাক হয়, বিস্মিত হয়।
দেশে প্রবাসীদের গুরুত্ব
আমাদের দেশের কথা যদি আমি বলি তবে বলব যে, আমাদের দেশে প্রবাসীদের কোনো গুরুত্ব নেই, আছে অবহেলা। একজন প্রবাসী দেশের জন্য কাজ করতে গিয়েও যতটুকু অবহেলা সহ্য করে আত্মসম্মানের বোধ ত্যাগ করে কাজ করে সেটা আসলে আমাদের এই দেশ কখনোই বোঝেনি বা বোঝার চেষ্টা করেছে বলে তা ততটা স্পষ্ট মনে হয় না আমার কাছে কারণ আমার কাছে আমাদের দেশে প্রবাসীদের মূল্য শূন্য। কেন এমন তা হয়তো আমার জানা না থাকলেও জানা আছে সরকার কিংবা সরকারের উচ্চপদস্থ নেতাদের।
আমাদের দেশে যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রবাসীরা যদি দেশ ত্যাগ করে না যেত তাহলে দেশ আর দেশের মতো থাকত না। দেশ বৃন্দাবনে চলে যেত। ব্যাপারটা অনেকটা হাস্যকর মনে হলেও তা সত্যি।
প্রবাসীদের ভাবনা
যারা প্রবাসে চলে গেছেন দেশ ছেড়ে তাদের আপন মানুষজন ছেড়ে তাদের ভাবনায় শুধু একটা ভাবনাই থাকে, আমার মা ভালো আছে তো! আমার বাবা ভালো আছে তো! আমার সন্তানরা ভালো আছে তো! এই ভাবনাগুলো তাদের আরো ভাবিয়ে তোলে যে, তাদের যত কষ্টই হোক না কেন তাদের উপার্জন করতে হবে। তখন তারা বুকে পাথর চাপা দিয়ে কাজে নেমে যায়, যে নেমে যাওয়ার মধ্যে আর কোনো দ্বিধা থাকে না, দ্বন্দ্ব থাকে না, থাকে শুধু একটাই ভাবনা যে, আমাকে ভালো কিছু করে দেশে গিয়ে পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। যে ফোটানোর মধ্যে কোনো ক্লান্তি থাকবে না, ক্লেদ থাকবে না, তৃষ্ণা থাকবে না, থাকবে না এর কোনোকিছু।
কেননা তারা তাদের কথা ভেবে প্রবাসে যায় না, তারা তাদের পরিবারের কথা, দেশের কথা ভেবে বিদেশ যায়। গিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তারা অর্থ উপার্জন করে দেশে পাঠায়। দেশ থেকে একজন মানুষ যখন প্রবাসে যায় তখন তার ভাবনায় সবচেয়ে আগে যে ভাবনাটা থাকে সেটা হলো আমাকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে, যে অর্থ দিয়ে আমি বিদেশে এসেছি আমাকে তা শোধ করে পরিবারের জন্য কিছু নিয়ে দেশে ফিরতে হবে। যে ফেরার মধ্যে থাকবে মমতা বা পাওয়ার ফেরা এবং তার কোনো কিছুর পাওয়ার ইচ্ছা পূরণের আকাঙ্খা।
দেশের সঙ্গে প্রবাসীদের সম্পর্ক
দেশের সঙ্গে প্রবাসীদের সম্পর্ক গভীর হয়েও গভীর হতে পারে না, তার কারণ প্রবাসীদের কখনোই দেশ সম্মানের চোখে দেখে না বা তাদের মূল্যবোধের জায়গাটা দেয় না। কারণ প্রবাসীরা দেশের বাইরে থাকে বলে। প্রবাসীরা দেশের জন্য দেশ ছেড়ে যায় অন্য দেশে এটা বুঝলেও বোঝে না দেশের মানুষ। বেশ বড় বড় মানুষ বলে, প্রবাসীরা দেশ ছেড়েছে দেশের প্রতি তাদের মায়া, দেশের প্রতি তাদের টান নেই বলে, কিন্তু তারা এটুকু বোঝে না বা এটুকু বোঝার ক্ষমতা তাদের নেই যে, আমাদের দেশে কর্মসংস্থানেরর অভাবেই তারা দেশ ছেড়েছে, আমাদের দেশের মানুষজনদের ভালো রাখার জন্য তারা দেশ ছেড়েছে।
দেশ প্রবাসীদের ভুলে গেলেও প্রবাসীরা কখনো দেশের কথা ভোলে না, তারা ভুলতে পারে না, কেননা সে সেদেশের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হতে পারে। সুতরাং বলা যায়, প্রবাসীদের সঙ্গে দেশে সম্পর্কটা ততটা বন্ধুত্বপূর্ণ না হলেও দেশের প্রতি প্রবাসীদের একটা টান আছেই শুরু থেকে। কেননা তারা তাদের আপনজনদের দেখা পাওয়ার জন্য যেখানেই যাক না কেন সবশেষে তাদের দেশেই ফিরে আসতে হয়, মা বলে ডাকার জন্য নিজের গ্রামটার মনোমুগ্ধকর প্রতিচ্ছবি তাকে বার বার দেখায় যেন তার টান, দেশের প্রতি তার মায়া আরো তীব্র হয়ে ওঠে তার কাছে।
যে তীব্রতায় মিশে থাকে মা, মাটি, দেশ, মমতা অনেক কিছু। যা আসলে প্রবাসীদের মতো করে ভেতরে ভেতরে আর কেউ এত গভীর করে লালন করতে পারে না। পারবেই বা কেমন করে, প্রবাসীরা যে তাদের মায়া ত্যাগ করে অন্য দেশের নাগরিকত্ব অর্জন করতে পারে না বা অর্জন করলেও তাদের বিবেক তাদের অর্জন করতে দেয় না, সবসময় তাদের ভেতরে ভেতরে বুকের মধ্যে বাজতে থাকে যে, এটা তোমার দেশ না, এটা তোমার দেশ না। তোমার দেশ বাংলাদেশ। তখন প্রবাসীরা নতুন করে সবকিছু দেখতে শুরু করে, যে দেখায় মিশে থাকে দেশের প্রতি গভীর মমতা।
এই মমতাই তাদের আবার দেশে ফিরিয়ে আনে, প্রিয় মানুষের কাছে এসে তারা তাদের মুখ দেখে প্রবাসে থাকার তৃষ্ণা দূর করে। প্রবাসীরা আমাদের দেশের সম্পদ। তারা না থাকলে আমাদের দেশের উন্নতি এতটা চোখে পড়ত না, বাংলাদেশের নামটা অন্যান্য দেশের মতো এত স্পষ্ট করে পরিচিতি পেয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারত না বা তার কাজ সম্পর্কে, এই দেশ সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণা হতো না।
প্রবাসীরা হলো একটি দেশের মোহর। যে মোহরের কারণে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে দেশ এবং দেশের মানুষ সুতরাং প্রবাসীদের ভালো থাকা বা ভালো রাখা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কিন্তু আমরা তার কতটুকু পালন করতে পেরেছি বা পারি তা হয়তো একটু লক্ষ্য করলেই বলতে পারি। দেশ থেকে প্রবাসীরা যখন বিদেশ যায় তখন তাদের প্রতি আমাদের বোধের জায়গাটা আরো খোলাসা হওয়া উচিত, যে খোলাসায় থাকবে স্পষ্টতা, গভীরতা, মমতা ও সম্মানবোধ।
দেশ-বিদেশের পার্থক্য
একজন মানুষ দেশে থেকে যে কোনো কাজ করতে পারে না কিন্তু প্রবাসে গিয়ে যে কোনো কাজ করতে পারে। কেননা তাকে অর্থ উপার্জন করে দেশে বাবা-মায়ের কাছে, স্ত্রী-সন্তানের কাছে পাঠাতে হবে। তখন তারা লোকচক্ষুর লজ্জা আড়াল করে ভাবে যে, আমাকে আমার যে কোনো কাজ করতে হবে এবং করেও। একজন প্রবাসী অন্যের বাসাবাড়ি দেখাশোনা থেকে শুরু করে সুইপারি পর্যন্ত করে। কিন্তু এতে লজ্জাটা কোথায়, এতে তো আনন্দ থাকার কথা, যে আনন্দের কিনা অর্থ উপার্জন করার সক্ষমতা থাকে বা তা পরিবারের মানুষদের মুখে হাসি ফোটানোর মতো বিন্দু পরিমাণ ক্লেদও যেন জমা না থাকে।
দেশে যে মানুষটা রিকশা চালিয়ে অর্থ উপার্জন করে সমাজ তাকে অবহেলার চোখে, অনীহার চোখে দেখে, কেননা সে মানুষটা রিকশা চালিয়ে অর্থ উপার্জন করছে। কিন্তু বিদেশে সেই মানুষটা গিয়ে এই একই কাজ করছে। কিন্তু এতে লজ্জা কোথায়। সে তো চুরি করছে না, সে কর্ম করছে, কষ্ট করে অর্থ উপার্জন করছে। এতে লজ্জা থাকবে কেন। এটাই তফাৎ দেশ আর বিদেশের মধ্যে। আমাদের দেশটা যে কারণে পেছনে পড়ে আছে তা হলো দেশের মানুষগুলোর মন ও মানসিকতা এখনো খুব নিচু হয়ে আছে। যে দেশ নিচু মনমানসিকতার মানুষ লালন করে সে দেশ কী করে এগিয়ে যাবে বা তার যোগ্য অনুযায়ী কর্ম দেবে, তা কখনোই সম্ভব নয়।
তা এখনো অবাস্তব আমাদের দেশে। এটা কখনো বাস্তব হওয়ার নয়। কেননা আমার দেশের সরকার যদি এই বিষয়টা নিয়ে একটু কাজ করত তাহলে হয়তো আমার দেশের মানুষেরা এই দেশ ছেড়ে প্রবাসে যেত না বা তাদের নিজ নিজ দেশে তারা কর্মসংস্থানের খোঁজে এগিয়ে আসত। কিন্তু না, তা এখনো সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি আমার দেশে বা সম্ভবপর হয়ে উঠবেও না কখনো।
লেখকঃ আহমাদুল কবির