সিনেমা হল বাঁচাতে উপমহাদেশীয় ভাষাভাষি সিনেমা আমদানি ইস্যুতে ১৯ সংগঠনের ঐকমত্যের পরও কিছু প্রশ্ন রয়ে গেছে। একদিকে জনসংখ্যার নিরিখে বড় অভ্যন্তরীণ বাজার চলচ্চিত্র সংস্কৃতিবিমুখ, অন্যদিকে ভালো সিনেমা প্রদর্শনে সঠিক আয়োজনের তীব্র অভাব। এই অবস্থার উত্তরণে উপমহাদেশীয় ভাষার সিনেমাগুলো আমদানির মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক ভাবনায় নিজস্ব সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর তাগিদ দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। তবে এমন তাগিদ অতীতেও বহু বিশিষ্টজন দিয়েছেন। আবার বহু দুষ্টুচক্র ফাঁক গলিয়ে ফায়দা লোটার আয়োজনে অগ্রণী হয়েছে। এবার আলোচিত ‘পাঠান’ সিনেমা নিয়ে সে আয়োজন কিছু আতঙ্কিত করে।
হলমালিকদের দাবির মুখে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো উপমহাদেশীয় সিনেমা আমদানির বিপক্ষের অবস্থান থেকে সরে এসে ‘আমদানির’ পক্ষে সায় দিয়েছে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রীর কাছে। সেখানে কয়েকটি শর্তও তারা জুড়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে একটি শর্ত কেবল প্রযোজকরাই সিনেমা আমদানি করতে পারবেন। উত্তম, তবে যে প্রযোজকরা এখন সরব তাদের অনেকেই অশ্লীল যুগের মাস্টারমাইন্ড। আবার কেউ মানবপচারের মতো অভিযোগে জেলখাটা আসামি। তাদের কারণে পরিবার নিয়ে হলে যাওয়ার প্রবণতা আজ শূন্যের কোঠায়। এদের মাধ্যমে যদি এবার আমদানির হিসাব খোলা হয় তবে চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় উপমহাদেশীয় পর্নো এখানে সয়লাব হবে। তাই এদের ঠেকাতেও একপক্ষ একাট্টা হয়েছে। আবার ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’ দিয়ে দর্শক হলমুখী হওয়ায় গত ছয় মাসের হিসাবে অধিকাংশ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমায় দর্শকসমাগম হয়েছে, তবে সেটা সাময়িক। এই অবস্থায় অন্ধকার দেখছেন হলমালিকরা। একদিকে সরকার ঘোষিত ঋণপ্রণোদনার অচলায়তন, অপরদিকে উপমহাদেশীয় সিনেমা আমদানিতে কালক্ষেপণ এই দুইয়ে মিলে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি চলচ্চিত্রাঙ্গন।
মধুবন সিনেপ্লেক্সের কর্ণধার রুবেল বলেন, ভালো সিনেমার অভাবে প্রেক্ষাগৃহ এমনিতেই বন্ধ রেখেছি। ভেবেছিলাম রোজার আগে ‘পাঠান’ এলে ক্ষতি পুষিয়ে লাভের মুখটা দেখব; কিন্তু সেটি আর হচ্ছে কই? এখন ভরসা ঈদে শাকিবের সিনেমা। তিনি বলেন, যে কোনো ভাষার সমসাময়িক সিনেমা আসুক, তা হলে আমাদের প্রযোজকদের মধ্যেও ভালো ও সৎভাবে সিনেমা নির্মাণের আগ্রহ তৈরি হবে। আমরা সেই কাজটাই দুই বছরজুড়ে করতে চাচ্ছি।
প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন বলেন, যেহেতু সামনেই রোজা তাই খরচ বাঁচাতে অনেকে এখনই বন্ধ করতে চাইছে। তাদের কোন আশায় এখন হল খোলা রাখার কথা বলতে পারি? আমাদের সামনে এখন বিকল্প পথও নেই। আমরা জানি না আর কী করলে আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন হলগুলো বাঁচাতে পারব। কে আনবেন, কাকে দিয়ে আনাবেন সেটি বিতর্কে না গিয়ে আমরা চাই সিনেমা আনুন, হলে দর্শক ঢোকার আয়োজন করুন। এতে সিনেমা হলগুলোর পরিবেশও ঠিক হয়ে আসবে, আর না আসতে দিলে হলগুলো গোডাউনে পরিণত হবে।
সমিতির সভাপতি কাজী শোয়েব রশিদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নেবেন না। যারা হিন্দি সিনেমার বিরোধিতা করছেন তারা ভুলে যাচ্ছেন রাত-দুপুরে তারাও হিন্দি সিনেমা, উর্দু সিনেমা দেখছেন। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের বিরোধিতায় হলগুলোকে বলি বানানো হচ্ছে। দ্রুত আমরা এ অবস্থার অবসান দাবি করছি, নয়তো হলমালিকরা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
তিনি বলেন, অনেকে আমাদের দেশপ্রেম নিয়েও কথা বলেছেন, তাদের উদ্দেশে বলছি আগেই বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতাম; কিন্তু ‘ওরা ৭ জন’ ও ‘জেকে ৭১’ নামে মুক্তিযুদ্ধের দুটি সিনেমা পূর্বনির্ধারিত রিলিজ ডেট নেওয়া আছে। হলমালিকদের অনুরোধ করেছি সিনেমা দুটির পাশে থাকতে। কারণ এ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে আমরাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করি।
উল্কা সিনেমা হলের কর্ণধার রফিকউদ্দিন বলেন, একটা হল চালিয়ে রাখার মতো সিনেমা আমাদের নেই। যে কারণে দুই বছরের একটা ধারণা প্রকল্প প্রেক্ষাগৃহ বাঁচানোর উপায় মনে হয়েছে। এরমেধ্য নিজস্ব সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। সে কারণেই উপমহাদেশীয় সিনেমা আমদানি দ্রুত হওয়া প্রয়োজন।
মধুমিতা সিনেমা হলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ বিরক্ত প্রকাশ করে বলেন, অনেক আগেই এসব নিয়ে কথা বলেছি, হ্যারাজ হয়েছি। সত্যি বলতে হল থাকুক আর না-ই থাকুক, সরকার যেভাবে চাইবে সেভাবেই হবে। এসব নিয়ে আর কথা বলে লাভ নেই।
এ ব্যাপারে চলচ্চিত্র গবেষক মীর শামসুল আলম বাবু বলেন, ১৯৬৫ সালে আইয়ুব সরকার পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হিন্দি সিনেমা বন্ধ করে নিজস্ব সক্ষমতার ওপর জোর দেন, সেটাই চলছে। বাস্তবতা হলো
বিশ্বায়নের এই যুগে এখন ঘরে বসেই হিন্দি-উর্দু সিনেমার পাঠ চুকিয়ে ফেলছেন দর্শক। তাই সরসারি এ দুটি ভাষার সিনেমা আসাটা খুব বেশি দোষণীয় বলে মনে হয় না। অন্যান্য ভাষার সঙ্গে যেহেতু আমরা পরিচিত নই, সেগুলো ডাবিং করে আনা যেতে পারে। তবে সংকট উত্তরণে এটা একমাত্র উপায় নয়, আমাদের ভাষার ওপর জোর দিয়ে বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ৪০ কোটি বাংলা ভাষার মানুষকে টার্গেট করে কনটেন্ট তৈরি করতে হবে।
সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রাগী’ সিনেমার নায়ক ও ব্যবসায়ী পারভেজ আবির চৌধুরী বলেন, ভাষার বিভাজন টানা উচিৎ হবে না। হিন্দি, উর্দু এ দুটি ভাষার সঙ্গে আমাদের এখানকার অনেকেই পরিচিত। আমি মনে করি প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টিতে অনেক আগেই উপমহদেশীয় ভাষাভাষির সিনেমা মুক্তির ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। ইতোমধ্যে ১০ ভাগ দর্শক সিনেমাটি দেখে ফেলেছে, তা হলে বিতর্ক তুলে লাভটা কী?
এক সিনেমা বোদ্ধা বলেন, এ দেশে ওয়াজ মাহফিল করার জন্য কোনো ধরনের আবেদন-নিবেদন বা আইনের বালাই না থাকলেও সংস্কৃতি চর্চায় অনেক বাধা। এখানে বিত্তশালীদের বিনোদনের ব্যবস্থা থাকলেও মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের বিনোদনের বড় মাধ্যম যে সিনেমা, সেটাও চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই সরকারের উচিত মৌলবাদ উৎপাটনে সংস্কৃতির বিকাশে চলচ্চিত্রের বিশ্বায়নকে স্বীকার করা। এক্ষেত্রে সস্তা সেন্টিমেন্টকে পাত্তা দেওয়া যাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সেলিনা বেগম ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এ প্রজন্মের দর্শক সিগমা বলেন, এটা খুব অন্যায় যে, একটা ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে অনেক কথা হয় অথচ সমাধান হচ্ছে না। এখানে সরকার বা ইন্ডাস্ট্রির সংশ্লিষ্টরা ভুলে যান যে, তাদের এই ঝগড়া-বিবাদের মধ্যেও চোরাপথ গলিয়ে দেশের ১০ ভাগ দর্শক ‘পাঠান’ দেখে ফেলেছে, অর্থটাও চলে গেলো আর আমরা ঝগড়ায় মত্ত। আমাদের মনে হয় সংস্কৃতি উপভোগের জায়গাগুলোকে মসৃণ রাখার দায়িত্ব সরকারের। না হলে চোরাপথের সংস্কৃতির দংশনে নীল হতে হবে এই জাতিকে।
অপরদিকে এসব যুক্তির বিপরীতেও আবেগতাড়িত যুক্তি রয়েছে। এদের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও ইতিহাসের নিরিখে সেন্টিমেন্টগুলোকে আমলে নিতে হবে। তাদের মধ্যে স্বনামধন্য পরিচালক-প্রযোজক ও চিত্রনাট্যকার দেলোয়ার জাহান ঝন্টু অন্যতম। যার ঝুলি হিন্দি-উর্দু সিনেমার অনুকরণে রিমেক করার ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। তা সত্ত্বেও তিনি হিন্দি-উর্দু ভাষায় সিনেমা আমদানির ঘোর বিরোধিতা করছেন।
নির্মাতা দেলোয়ার জাহান ঝন্টু বলেন, হলমালিকরা হলব্যবসায়ী। তারা আমাদের সিনেমা নামিয়ে দিয়ে পাঠান চালাতে চান। পাঠান ৮০ শতাংশ উর্দু ভাষার সিনেমা। আর সেই সিনেমা আমাদের দেশে চলবে কেন? এই সিনেমা যারা আনতে চাচ্ছে তারা রাজাকারের থেকেও খারাপ। এই ৮০ শতাংশ উর্দু ভাষার সিনেমা আমাদের দেশে চলবে না।
প্রযোজক-প্রদর্শক ও অভিনেতা মনোয়ার হোসেন ডিপজলের যুক্তি ছিল ভাষার মাসে কেন বিদেশি ভাষার (হিন্দি) ছবি আমদানি? এটা তিনি সমর্থন করেন না।
তার বক্তব্য ‘ভারত থেকে বাংলা ছবি আসুক। সেটাতে আমার আপত্তি নেই। বাংলা ছবি তো আসেই, এসে তো আবার পেছনে হটে যায়; কিন্তু হিন্দি কেন আসবে? এটা তো হিন্দির দেশ না। এটা বাংলাদেশ, এখানে যদি কলকাতার বাংলা ছবি আসে, সেটা আসুক।’
সংকটক উত্তরণে ডিপজলের ফর্মুলা ‘আমাদেন সিনেমা দিয়েই সমাধান করতে হবে। এর আগে যখন চলচ্চিত্রে অস্থিরতা ছিল তখন তো আমরাই উত্তরণ করেছিলাম; সেভাবেই করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের সিনেমা নতুন করে আবার ঘুরে দাঁড়াবে। বাঙালি হিন্দি নয়, বাংলা সিনেমা দেখতে চায়। আমাদের দেশ হিন্দির নয়। সংকট উত্তরণের জন্য সবার এক হয়ে কাজ করতে হবে।’
বিশিষ্ট কলামিস্ট ও ডেইলি অবজার্ভারের সহকারী সম্পাদক ইমরান রহমান আপতকালীন সিনেমা আমদানির জন্য একটা পরিচ্ছন্ন নীতিমালা তৈরির ওপর জোর দেন। বলেন, চটজলদি না করে এই নীতিমালা করা এবং একটি কমিটি প্রয়োজন। একই সঙ্গে এই কমিটি নিজস্ব টেকসই সক্ষমতার জন্য প্রয়োজনীয় করণীয় ঠিক করে বাস্তবায়নের নির্দেশনাও দেবে।