ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশের চরিত্র পাল্টে যাচ্ছে। গুলিতে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ নিহত হওয়ায় বেকায়দায় পড়েছে শীর্ষ অপরাধ নিয়ন্ত্রণকারী এ বাহিনী। অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশের ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক তথা আইজিপি থেকে শুরু করে কনস্টেবল সব সদস্যের রদবদল হয়েছে। সম্পূর্ণ সংস্কারের জন্য গঠন করা হয়েছে কমিশন। কমিশন তাদের কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছে।
বিভিন্ন মহল থেকে পুলিশের পোশাক, মনোগ্রাম ও ক্যাপ থেকে নৌকার ছাপ পরিবর্তন করার দাবি উঠেছে। সংস্কার কমিশনও এ দাবির প্রতি একাত্মতা পোষণ করে পুলিশের পোশাক পরিবর্তনের প্রাথমিক সুপারিশ করেছে। পুলিশ কর্তৃপক্ষও চাচ্ছে পোশাক পরিবর্তন করতে। এজন্য একটি কমিটি গঠন করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। আইজিপি থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত একই ধরনের পোশাক পরিধান এবং মনোগ্রাম ও ক্যাপ (টুপি) থেকে নৌকাচিহ্ন পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারের শীর্ষপর্যায় সম্মতি দিলে আগামী বছরের মাঝামাঝি নতুন পোশাক ব্যবহার করবে পুলিশ। পোশাকের রঙ নিয়ে গবেষণা চলছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানান, ঢাকা মহানগর পুলিশসহ সারা দেশের পুলিশ সদস্যদের জন্য একই রকমের পোশাকের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পোশাকের হাতের অংশে রেঞ্জ, জেলা, ইউনিট ও মেট্রোপলিটন পুলিশের মনোগ্রাম থাকবে। নৌকার ছবি থাকবে না। তবে পোশাকের রঙ কী হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। কয়েকটি রঙ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। নিজস্ব ফ্যাক্টরি থেকে কাপড় কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এজন্য একজন উপমহাপরিদর্শককে (ডিআইজি) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানা করার পরিকল্পনা আছে পুলিশ সদর দপ্তরের। ২০০৪, ২০১৬ ও ২০২১ সালে পুলিশের কয়েকটি ইউনিটের পোশাকের রঙ পরিবর্তন করা হয়েছিল। সর্বশেষ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) পোশাক পরিবর্তন করা হয়েছে। পোশাক কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ আছে।
মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের অভিযোগ, পোশাকের কাপড় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিম্নমানের। এসব পোশাক সারাদিন পরে থাকা যায় না। গরম লাগে। অনেকে নিজের টাকায় ভালো মানের কাপড় কিনে পোশাক তৈরি করে থাকেন। আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতনদের পোশাকের কাপড়ের মান উন্নত। আর এসআই, এএসআই ও কনস্টেবলদের কাপড়ের মান নিম্ন। রঙেও ভিন্নতা রয়েছে।
পুলিশ-সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানান, ব্রিটিশ আমল থেকে পুলিশের পোশাক ছিল খাকি। অনেক আগেই পোশাকের রঙ বদলেছে। মহানগর ও জেলাপর্যায়ে দুই রঙের পোশাক দেওয়া হয়। তবে, পুলিশের ইউনিট ও ব্যাটালিয়নভেদে পোশাকের ভিন্নতাও রয়েছে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও স্পেশাল সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রোটেকশন ব্যাটালিয়নের (এসপিবিএন) পোশাক সম্পূর্ণ ভিন্ন রঙের। ২০০৪ সালে পুলিশের পোশাক পরিবর্তন করে মহানগরগুলোয় হালকা জলপাই রঙের করা হয়। জেলা পুলিশকে দেওয়া হয় গাঢ় নীল রঙের পোশাক। র্যাবের কালো ও এপিবিএনের পোশাক তৈরি করা হয় খাকি, বেগুনি আর নীল রঙের মিশ্রণে। এসপিবিএনের পোশাকের জামার রঙ করা হয় ধূসর রঙের। প্যান্টও ভিন্ন ভিন্ন রঙের। বর্তমানে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা এসব পোশাক পরেই দায়িত্ব পালন করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিরীহ শিক্ষার্থী ও লোকজনের প্রাণহানির ঘটনায় পুলিশ সরাসরি জড়িত। ফলে পুলিশের পোশাকটি দেখলে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়। নতুন সরকারের আমলে পুলিশের পোশাক বাতিল করে নতুন পোশাকের জোরালো দাবি উঠেছে। সংস্কার কমিশনও পোশাক পরিবর্তনে মত দিয়েছে।
সংস্কারের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। জনসাধারণের মতামত নিয়েছি। অংশীজনদের প্রস্তাব পেয়েছি। সবকিছুর পর্যালোচনা চলছে এখন। পোশাক পরিবর্তনের সুপারিশ করা হবে।’
সূত্র জানায়, সংস্কার কমিটির প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে, স্বাধীন কমিশন গঠন ও পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত এবং জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত রাখা, ৫ আগস্টের আগে পুলিশ যে ইউনিফর্ম (পোশাক) পরে কলঙ্কিত হয়েছে, তার রঙ পরিবর্তন করা ও কনস্টেবল থেকে আইজি পর্যন্ত একই ড্রেস কোড চালু করা। কমিশনের প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, শ্রম আইন অনুযায়ী পুলিশ সদস্যদের কর্মসময় আট ঘণ্টা নিশ্চিত করা, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনকে ওভারটাইম হিসেবে গণ্য করা, পরিদর্শকদের থেকে ৬০ শতাংশ এবং ৪০ শতাংশ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) সরকারি কর্মকমিশনের মাধ্যমে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া, জটিলতা নিরসনে সুপারনিউমারারি পদোন্নতি চালু করা এবং ন্যূনতম পুলিশ সুপার পর্যন্ত পদোন্নতির ব্যবস্থা করা।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সারা দেশের পুলিশ সদস্যরা একই ধরনের পোশাক যাতে ব্যবহার করতে পারেন, সেজন্য তিনি কিছু প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। মেট্রোপলিটন, রেঞ্জ, জেলাসহ বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যদের পোশাক একই ধরনের হবে। পোশাকের ডান-বাম হাতের ওপরের অংশে শুধু ইউনিট, রেঞ্জ, জেলা ও মেট্রোপলিটন পুলিশের লোগো থাকবে। পুলিশের মনোগ্রাম থেকে নৌকা; ক্যাপ, ব্যাজ ও বেল্ট থেকে নৌকার সঙ্গে বইঠা বাদ দেওয়া হবে।
পুলিশ কর্তারা বলেন, পুলিশের প্রতিটি সদস্যই উন্নতমানের পোশাক ব্যবহার করবেন। প্রয়োজনে নিজেরাই পোশাক তৈরি করবেন। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। একজন উপমহাপরিদর্শককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মাঠপর্যায়ের পুলিশের একাধিক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিদর্শক থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পুলিশের সরবরাহ করা পোশাক পান না; তারা পান পোশাক-ভাতা। পুলিশের পোশাক বিক্রির জন্য ঢাকাসহ সারা দেশে কিছু অনুমোদিত দোকান রয়েছে। কনস্টেবল থেকে উপপরিদর্শক পদবির কর্মকর্তারা বছরে দুটি করে হাফ-শার্ট ও প্যান্ট এবং একটি ফুল-শার্ট পেয়ে থাকেন। আইজিপি স্যার পুলিশের সব পোশাক একই ধরনের করার কথা বলেছেন। আমরা আশা করব কাপড়ের মান যাতে উন্নত হয়। কোনো অভিযোগ যাতে না থাকে। পোশাকগুলো যেন একস্থান থেকেই আমরা সরবরাহ করতে পারি। তাহলে অপরাধীরা পুলিশের পোশাক পরে অপকর্ম করতে পারবে না।’