সোমবার, ০৯:৫৩ পূর্বাহ্ন, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

পাকিস্তানে কী রপ্তানি করে বাংলাদেশ, হঠাৎ বাণিজ্য আলোচনায় কেন

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক:
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৪
  • ০ বার পঠিত

সম্প্রতি পাকিস্তানের করাচি থেকে কন্টেইনার বহনকারী একটি জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর ঘটনা ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো এমন সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হলো, যা বাংলাদেশ-পাকিস্তান বাণিজ্য সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।

এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা চলছে, যেখানে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা এবং বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর সুযোগ নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।  দূরত্বের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে, যদি সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

গবেষক ও আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, সরাসরি জাহাজ ও বিমান চলাচল চালুর পাশাপাশি, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি, মান নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে সার্টিফিকেট গ্রহণের প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং পারস্পারিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে বাণিজ্য বহুগুণ বাড়ানো সম্ভব। তারা বিশ্বাস করেন, এর ফলে উভয় দেশই সমানভাবে লাভবান হতে পারে।

অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম দেশের বাণিজ্য সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করছেন।  তিনি জানান, বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য একটি যৌথ কারিগরি দল গঠন করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে উভয় দেশের মধ্যে বিনিয়োগভিত্তিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হতে পারে এবং নতুন বাণিজ্য চুক্তি বাস্তবায়নের পথ খুলে যাবে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম বলেন, পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশিদের জন্য ভিসামুক্ত পাকিস্তান সফরের ঘোষণা দিয়েছে, যা বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করতে সহায়ক হতে পারে। তার মতে, এটি দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার সুযোগ এনে দিয়েছে।

কী ধরনের পণ্যের বাণিজ্য হচ্ছে

করাচি থেকে বাংলাদেশে সরাসরি আসা যে জাহাজ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেই জাহাজে বাংলাদেশে এসেছে ‘ফেব্রিকস, চুনাপাথর, সোডা অ্যাশ, পেঁয়াজ, ম্যাগনেসিয়াম কার্বোনেট ও ডলোমাইট’, যার বেশিরভাগই টেক্সটাইল শিল্পের কাঁচামাল।

পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশে প্রায় ৬৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল সুতা-কাপড় ও প্রস্তুত চামড়া ছিল প্রায় ৭৯ শতাংশ।

বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়েছে, তার মূল্য ছিল ৬ কোটি ডলারের সামান্য বেশি। মূলত কাঁচা পাট, ওষুধ, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, চা ও তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছিলো বাংলাদেশ।

এর আগে ২০২২ সালে বাংলাদেশ ৭৪ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি করলেও পাকিস্তান থেকে আমদানি করেছে ৮৪০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ পণ্য পাকিস্তানের রপ্তানি হয়, তার দশগুণ বেশি পাকিস্তান বাংলাদেশে রপ্তানি করে।

পাকিস্তান থেকে গত বছর সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে তুলা। এছাড়া আরও যেসব পণ্য আসে বাংলাদেশে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আসে সিমেন্টের কাঁচামাল।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে রপ্তানি হয় এমন যেসব পণ্যের নাম দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে আছে-পাট ও অন্য টেক্সটাইল ফেব্রিকস, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, পেপার ও পেপারবোর্ড লেবেল, ছেলেদের শার্ট, মেডিকেল সার্জিক্যাল ও ডেন্টাল ইকুইপমেন্টসহ আরও কয়েকটি পণ্য।

ড. আইনুল ইসলাম বলছেন, বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য, গার্মেন্ট, মেডিসিন, লেদার – এসব ক্ষেত্রে পাকিস্তানে রপ্তানি বাড়ানোর সম্ভাবনা বেশি। অন্যদিকে পাকিস্তানের সিলিং ফ্যান, ফ্রুটস, জুস, মেয়েদের ড্রেস বাংলাদেশে জনপ্রিয়।

‘কস্ট বেনিফিট পর্যালোচনা করে আমদানি-রপ্তানির পণ্য ঠিক হলে উভয় দেশই তাতে লাভবান হবে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, উভয় দেশের মধ্যে কোন ধরনের পণ্যের কেমন চাহিদা, সেগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে।

‘পাকিস্তান থেকে কটন বা টেক্সটাইল কাঁচামাল সম্ভাব্য পণ্য হতে পারে যা মূলত ভারত ও চীন থেকেই বেশি আসে। আবার পাকিস্তানের লাইট ইনজিনিয়ারিং পণ্যের ভালো সম্ভাবনা আছে বাংলাদেশে।’

তার মতে বিনিয়োগকারীরা উভয় দেশে চাহিদার ভিত্তিতে যৌথ বিনিয়োগ করতে পারে। ‘বাংলাদেশে ওষুধ ও গার্মেন্টস কারখানা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অঞ্চলে করতে পারে। এর ফলে পাকিস্তান ছাড়াও ইরানসহ মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর বাজারে প্রবেশ সহজ হতে পারে,’ বলছিলেন তিনি।

শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ আরিফ আহমেদ বলছেন, এক সময় বাংলাদেশি পাট ও পাটজাত দ্রব্যের প্রচুর চাহিদা ছিল পাকিস্তানে।

‘সেটি এখন তেমন না থাকলেও বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল আসছে। আমাদেরও গার্মেন্টস সহ বিভিন্ন পণ্য অল্প হলেও যাচ্ছে,’ বলছিলেন তিনি।

হঠাৎ বাণিজ্য আলোচনায় কেন

বাংলাদেশে গত পাঁচই অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর থেকেই ঢাকায় পাকিস্তানি হাইকমিশনার আহমদ মারুফ নতুন সরকারের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা, এফবিসিসিআই এর প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে সাক্ষাত করে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন।

এসব সাক্ষাতে তিনি পারস্পারিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থে সরাসরি ফ্লাইট চালুর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সাথে সাক্ষাতে তিনি গত পনের বছরে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্কে যে শুষ্কতা এসেছে তা দূর করতে পারস্পারিক সম্পর্ক জোরদারের আহবান জানান।

এর মধ্যে এফবিসিসিআই এর প্রশাসক হাফিজুর রহমানের সাথেও বৈঠক করেন তিনি।

যেখানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি, যৌথ বিজনেস কাউন্সিল, উভয় দেশের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে সার্টিফিকেট গ্রহণ, হালাল খাদ্য আমদানি-রপ্তানি, এসএমই, ফার্মাসিউটিক্যাল এবং অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাত নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয় বলে জানানো হয়েছিলো।

তবে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্যের বিষয়টি বড় ধরনের আলোচনায় আসে করাচি থেকে সরাসরি বাংলাদেশে জাহাজ আসার খবর।

পাকিস্তান হাইকমিশন গত ১৩ নভেম্বর তাদের ভেরিফায়েড এক্স (পূর্বের টুইটার) হ্যান্ডেলে এটিকে ‘দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে।

ওই টুইটে তারা বলেছে, এই ‘নতুন রুট সরবরাহ ব্যবস্থাকে শৃঙ্খলার মাঝে আনবে, ট্রানজিট সময় কমিয়ে দেবে এবং উভয় দেশের জন্য নতুন ব্যবসার সুযোগ খুলে দিবে’।

গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, ভৌগলিক দূরত্ব ও সরাসরি জাহাজ চলাচল না থাকায় দুই দেশের বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি হয়নি।

‘এখন বাংলাদেশের পণ্য পাকিস্তানে যেতে হলে দুবাই বা শ্রীলংকা হয়ে করাচি যায়। আবার কখনো করাচি থেকে দুবাই কলম্বো হয়ে বাংলাদেশে আসতে পারে। এর ফলে বাণিজ্য ব্যয় বৃদ্ধি পায় ও সময় বেশি লাগে। স্বাভাবিক বাণিজ্য এতে বাধাগ্রস্ত হয়।’

এর মধ্যে আওয়ামী লীগ আমলে পাকিস্তান থেকে আসা পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছার পর শতভাগ কায়িক পরীক্ষা শেষে অনুমোদন পেলেই কেবল ছাড় দেওয়া হতো। বাংলাদেশের রাজস্ব বোর্ড গত ২৯ সেপ্টেম্বর সেই বিধান তুলে নিয়েছে।

এতে পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানি দ্রুত হবে এবং জটিলতাও কাটবে বলে মনে করা হচ্ছে।

সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলছেন, ব্যবসায়ীদের দাবি হলো সরাসরি জাহাজ চলাচল এবং এটি হলে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য আরও অনেক বাড়বে।

‘তখন বাংলাদেশও তার পণ্য রপ্তানি বাড়াতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারবে,’ বলছিলেন তিনি।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com