হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১২টি উড়োজাহাজ পরিত্যক্ত অবস্থায় বছরের পর বছর ধরে পড়ে আছে। প্রায় এক যুগ পরিত্যক্ত অবস্থায় রানওয়েতে পড়ে থাকায় অনেকটাই ভাঙাড়িতে পরিণত হয়েছে এগুলো। এসব উড়োজাহাজ নিলামে তোলার কথা বলা হলেও এখনও নিলাম ডাকতে পারেনি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। কারণ নিলামে তোলার আগে এসব উড়োজাহাজের মূল্য নির্ধারণের জন্য আন্তর্জাতিক পরামর্শক বা প্রতিষ্ঠান লাগবে। উপরন্তু নিলাম নিয়েও রয়েছে জটিলতা। এসব উড়োজাহাজ যেসব কোম্পানির, তারা বলছে- বেবিচক চাইলেই নিলামে তুলতে পারবে না। আইনগত ঝামেলায় পড়বে। কারণ সব কোম্পানির ব্যাংকের কাছে দায় রয়েছে। ফলে ব্যাংক এগুলো বিক্রি করতে দেবে না।
অন্যদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেবিচক নিলামে তোলার লক্ষ্যে উড়োজাহাজগুলোর মূল্য নির্ধারণের জন্য আন্তর্জাতিক পরামর্শক নিয়োগ দেওয়ার যে পরিকল্পনা করছে, তাতে অযথা অর্থের শ্রাদ্ধ হবে। পরামর্শককে যত টাকা দিতে হবে, বিক্রি করে এর ৫ ভাগের একভাগও উঠবে না। এর চেয়ে কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে বিক্রি করলে উভয়েই লাভবান হতো। সব মিলিয়ে পরিত্যক্ত উড়োজাহাজগুলো এখন বেবিচকের ‘গলার কাঁটা’ হয়ে পড়েছে।
শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, বাজেয়াপ্ত করা উড়োজাহাজগুলো নিলামের জন্য বেবিচক সদরদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। মূল্য নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। কমিটি প্রতিবেদন দেওয়ার পর পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিলাম আহ্বান করা হবে।
গত বছর বলা হয়েছিল, নিলামে তোলার সব প্রক্রিয়া শেষ। কিন্তু এখন বেবিচক বলছে, নিলামে তোলার আগে এসব উড়োজাহাজের মূল্য নির্ধারণের জন্য আন্তর্জাতিক পরামর্শক বা প্রতিষ্ঠান লাগবে। কিন্তু আমাদের এমন জ্ঞানসম্পন্ন ও পূর্ব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোকবল নেই। এ জন্য আন্তর্জাতিকভাবে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পরামর্শক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করার জন্য কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি আন্তর্জাতিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করার পর মালামালের মূল্যও নির্ধারণ করে দেবে। এর পরই টেন্ডারের মাধ্যমে এগুলো নিলামে বিক্রি করা হবে। দ্রুত এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি নিয়োগ দেওয়ার আগে দেশীয় এয়ারলাইন্সের কাছে সহায়তা চাওয়া হবে। বেবিচক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, নিলামের নামে শুধু শুধু কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। দেখা যাবে, নিলামে বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে, পরামর্শককে বেতন বাবদ তার চেয়ে বেশি টাকা দিতে হবে। অপরদিকে প্রায় এক যুগ ধরে শাহজালালে এগুলো জায়গা দখল করে আছে। এগুলো না থাকলে ৭টি উড়োজাহাজ রাখা যেত। সেগুলোর যে ভাড়া পাওয়া যেত, তার সিঁকি ভাগও নিলামে পাওয়া যাবে না। ফলে উভয় দিকেই আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।
বেবিচক সূত্র জানায়, দীর্ঘ প্রায় এক যুগ ধরে পার্কিংয়ে পড়ে থাকা এসব উড়োজাহাজ গলার কাঁটা হয়ে আছে। চার কোম্পানির এসব উড়োজাহাজের জন্য পার্কিং সারচার্জের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৫০ কোটি টাকা। কোম্পানিগুলো এই টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় এবং কার্যক্ষমতা নষ্ট হওয়ায় এসব বিমানকে অবশেষে নিলাম করেই বিক্রি করতে হচ্ছে। এর মধ্যে ইউনাইটেডের ৮টি, রিজেন্ট এয়ারওয়েজের দুটি, জিএমজির একটি ও এভিয়েনা এয়ারলাইন্সের একটি করে উড়োজাহাজ রয়েছে। এগুলো সরিয়ে নিতে মালিকপক্ষকে বারবার চিঠি দেওয়া হলেও পার্কিং ও সারচার্জ জমা দেওয়ার ভয়ে তারা সরিয়ে নেয়নি।
সূত্র আরও জানায়, গত ১১ বছরে এই ১২টি উড়োজাহাজের পার্কিং ও সারচার্জ বাবদ বকেয়া প্রায় ৮৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ বকেয়া জিএমজি এয়ারলাইন্সের। জিএমজির কাছে ৩৬০ কোটি টাকা পায় বেবিচক। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট স্থগিত করে জিএমজি এয়ারলাইন্স। এরপর আর কখনও আকাশে ডানা মেলেনি। আর রিজেন্ট এয়ারওয়েজের কাছে বেবিচকের পাওনা ২০০ কোটি টাকা। ২০২০ সালের মার্চে বন্ধ হয় রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। তবে তার আগেই বেশ কয়েকটি রুটে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করে দেয় সংস্থাটি। এর বাইরে পার্কিং চার্জ ও সারচার্জ বাবদ ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কাছে বকেয়া ৩৫৫ কোটি টাকা। দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত একমাত্র উড়োজাহাজ কোম্পানি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ বন্ধ আছে ২০১৬ সাল থেকে।
বেবিচক সূত্র জানায়, গত মাসের বেবিচকের ২৯৭তম বোর্ডসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বলা হয়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রপ্তানি কার্গোর সামনে অ্যাপ্রোন এরিয়ায় পরিত্যক্ত অবস্থায় ১২টি উড়োজাহাজ ও এর আনুষঙ্গিক মালামাল রয়েছে। গত ১০ ?জুন এগুলো বাজেয়াপ্ত করে নিলামে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মালামালের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এগুলো নিলামের জন্য ভিত্তিমূল্য নির্ধারণের জন্য বেবিচকে অভিজ্ঞাসম্পন্ন লোকবল না থাকায় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠন করতে হবে। তবে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেড বা অন্য কোনো সংস্থার কাছ থেকে সহায়তা নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। পরে নিলামে বিক্রি করতে ভিত্তিমূল্য নির্ধারণের জন্য প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ও বঙ্গবন্ধু অ্যারোনটিক্যাল সেন্টারকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
একটি এয়ারলাইন্সের শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, আমরা আমাদের উড়োজাহাজগুলো বিক্রি করার জন্য আন্তর্জাতিক কোটেশন বেবিচকের কাছে জমা দিয়েছিলাম, সেটি বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যেত, তা দিয়ে বেবিচকের পাওনা পরিশোধের কথা বলেছিলাম। কিন্তু বেবিচক শোনেনি। তারা এখন এগুলো কেজি দরে বিক্রি করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তা পারবে না। কারণ ব্যাংকের কাছে আমাদের লোন আছে। ব্যাংক তা করতে দেবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, আমরা ৩০০ কোটি টাকা সারচার্জ মওকুফের জন্য আবেদন করেছিলাম। আর মূল বকেয়া ৫৫ কোটি টাকা এয়ারলাইন্স চালু হওয়ার পর ক্রমান্বয়ে দেব বলেছিলাম। এ প্রস্তাবে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্মতি দেয়নি। ফলে এয়ারলাইন্স পরিচালনায় এওসি নবায়ন করতে পারিনি। এখন পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
উড়োজাহাজগুলো জায়গা দখল করে আছে এগুলো খালি করা দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, বেবিচক এগুলো বিক্রি করলে ১০০ ভাগের ১ ভাগ দামও পাবে না। এয়ারলাইনসগুলো চেয়েছিল এগুলো বিক্রি করতে, তাতে তারা কিছু টাকা পেত, বেবিচকের পাওনাও কিছু দিতে পারত। বেবিচক এ বিষয়ে নীতিগতভাবে রাজি হয়নি। এগুলো পুরনো হলেও এগুলোর রিসেল দাম আছে। বেবিচক সেভাবে করতে পারবে না। এয়ারলাইন্সগুলোর ব্যাংকে লোন থাকায় ব্যাংক এগুলো বিক্রির অনুমতি দেবে না। এখানে আইনগত ঝামেলা রয়েছে।