দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর এখন এর ময়নাতদন্ত শুরু হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসবে, নির্বাচনটি কেমন হলো? ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, এই নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের জয় হয়েছে। জনগণ হরতাল আহ্বানকারীদের প্রত্যাখ্যান করেছে। বিরোধী দল বিএনপি বলছে, এই নির্বাচন ভোটাররা নাকচ করেছেন। নির্বাচন কমিশনের দাবি, তারা দেশবাসীকে একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দিয়েছে।
এদের সবার দাবির মধ্যে যেমন সত্য আছে, তেমনি আছে সত্যের ঘাটতিও। যেকোনো বিষয়কে ইতি ও নেতি—দুভাবেই দেখা যায়। কেউ বলেন, গ্লাসের অর্ধেক খালি, কেউ বলেন, অর্ধেক পূর্ণ। সমস্যা হলো অর্ধেক পূর্ণ বা খালি কেউ স্বীকার করতে চান না। সবাই যখন গ্লাস পূর্ণ করার দাবি করেন, তখন সেটি ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে গ্লাসটি হলো ‘জনগণ’।
গণতন্ত্র হলো একসঙ্গে চলা। গণতন্ত্র হলো একসঙ্গে কাজ করা। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব একসঙ্গে চলতে বা কাজ করতে ইচ্ছুক নন। নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টেকসই হওয়ার কথা ছিল। আন্দোলনে জয়ী আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও অন্যান্য দল মিলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটি রূপরেখাও প্রণয়ন করেছিল। ক্ষমতায় এসে তারা সেটি ভুলে যায়। এক দল স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে সখ্য করে, আরেক দল স্বৈরাচারের সঙ্গে হাত মেলায়।
একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অপরের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ধ্বংসের নালিশ জানায়। এই নালিশ কেবল দেশের ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকে না, বহির্বিশ্বেও জানিয়ে দেওয়া হয়। বিরোধী দলে থাকতে গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য যারা বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ করে বেড়ান, ক্ষমতায় গিয়ে তাঁরাই বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে বুলন্দ আওয়াজ তোলেন।
আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অনাস্থা-বৈরিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আওয়ামী লীগ বিএনপি সরকারের অধীনে এবং বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে নারাজ।
এ প্রসঙ্গে অনেক দিন আগে লেখা ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক এস আর সেনের ‘বাংলাদেশ: ঘুরে দাঁড়ানো ও সম্ভাবনা’ নিবন্ধটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৯১ সালের এপ্রিলে তিনি লিখেছেন, ‘১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটাতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর যে ঐক্য হয়েছিল, তা ছিল নজিরবিহীন। কিন্তু এরশাদের পতনের পরপরই ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের সময় ও নির্বাচনের পরে সেই দলগুলোর ঐক্য ভেস্তে গেল এবং তাদের মধ্যে তুমুল অনৈক্য দেখা গেল।
বিষয়টি বাইরের পর্যবেক্ষকদের খুব অবাক করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাস ও ভৌগোলিক অবস্থা সম্পর্কে যাঁর সম্যক ধারণা আছে, তাঁর কাছে এটি মোটেও অবাক করার মতো কিছু ছিল না। (ঢাকা কুরিয়ার, ১৬ এপ্রিল ১৯৯১)
এস আর সেন বাংলাদেশের রাজনীতিকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন। তিনি ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক ছিলেন। ১৯৪৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁকে প্রয়াত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ঢাকা ত্যাগ করতে বাধ্য করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে একসঙ্গে চলতে পারে না, ইতিহাসে তার ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। দেশ বিভাগের পর এ দেশের রাজনীতিতে যেসব দিক পরিবর্তনকারী ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে চুয়ান্নর নির্বাচন অন্যতম। এই নির্বাচনে জয়ী যুক্তফ্রন্ট এক বছরের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের পেছনে তৎকালীন ছাত্রলীগ ও তরুণ নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
এই তরুণ নেতৃত্বের একাংশ স্বাধীনতার পর সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে জাসদ গঠন করে এবং দুই পক্ষ এমন অবস্থায় চলে যায় যে একে অপরের পরাজয়ের মধ্যে নিজের বিজয় দেখতে পায়। সাড়ে চার দশক পরও সেই ধারা চলছে। দল ও নেতৃত্বের বদল হয়েছে মাত্র।
আপাতদৃষ্টে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনটি ‘সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ’ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের অবদান কতটা আর বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জনের অবদান কতটা, সেসব নিয়ে এখন রাজনৈতিক মহলে জোর আলোচনা চলছে। নির্বাচনে যদি বিএনপি অংশ নিত, তাহলে ভোটের পুরো চিত্র পাল্টে যেত। নৌকার বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হতো দলকে জিতিয়ে আনার স্বার্থে। তখনই প্রকৃতপক্ষে সমানে সমান লড়াই হতো। কিন্তু নির্বাচনের যে মূলকথা অনেকের মধ্য থেকে একজনকে বাছাই করার সুযোগ, সেটা এই নির্বাচনে ছিল না।
এবারের নির্বাচনে প্রতিটি আসনে গড়ে পাঁচজন প্রার্থী থাকলেও নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ১৫টি অংশ নেয়নি। আওয়ামী লীগের বাইরে যারা অংশ নিয়েছে, তারাও ‘আওয়ামী পরিবারের’ সদস্য। ফলে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকধারী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে। সে ক্ষেত্রে জনগণের বাছাই করার ওইটুকু সুযোগ ছিল—আওয়ামী লীগের দুই বা ততোধিক প্রার্থীর মধ্যে একজনকে বেছে নেওয়া।
নির্বাচনটি সুষ্ঠু হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে, তা বলা যাবে না। যে নির্বাচনে ভোটাররা আগেই জেনে যান কে জয়ী হবেন, সেই নির্বাচনে তাঁরা কেন আগ্রহ দেখাবেন? বিএনপি যতই সমালোচনা করুক, আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই মনে করে, ২০০৮ সালের নির্বাচনটি ছিল আদর্শ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে ভোট পড়েছিল প্রায় ৮৭ শতাংশ। আর ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোট পড়েছে সিইসির দাবি অনুযায়ী ৪১.৮ শতাংশ। বাকি ভোটগুলো কোথায় গেল?
বিএনপি বলছে, তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জনগণ ভোট বর্জন করেছেন। সরকার বলছে, বিএনপির নাশকতা ও ভয়ভীতির কারণে ভোটারের উপস্থিতি কম ছিল। বিএনপি নির্বাচনে এলে কী হতো, সেটা এখন ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’র বিষয়। আসল কথা হলো দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর যে আশা ছিল, সব দলের অংশগ্রহণে উৎসবমুখর পরিবেশে একটি নির্বাচন হবে, সেটি হলো না। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল বিএনপি, নির্বাচন কমিশন—সবাই নিজের সাফল্য দাবি করছে। কিন্তু জনগণ তখনই জয়ী হতো, যখন সব দলের অংশগ্রহণে ভয়ভীতিমুক্ত পরিবেশে নির্বাচনটি হতো।
এই একপক্ষীয় নির্বাচনেও অনেক নির্মম সত্য উঠে এসেছে। প্রথমত, প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বের ব্যর্থতা। আওয়ামী লীগ মনোনয়ন বোর্ড ১৪ দলের শরিকদের বাইরে ২৬৬টি আসনে নৌকা দিয়েছিল। এর মধ্যে আদালতের রায়ে একটি ও নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তে একটি বাতিল হয়ে যায়। দলের নৌকাধারী ২৬৪ প্রার্থীর মধ্যে জিতে এসেছেন ২২২ জন। হেরেছেন ৪২ জন। এসব আসনের দু-একটা বাদে সব কটিতে আওয়ামী লীগেরই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। এর অর্থ আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বেশি জনপ্রিয়ে প্রার্থীকে বাদ দিয়ে কম জনপ্রিয় প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছেন। এর মধ্যে শীর্ষ নেতৃত্বের অত্যন্ত আস্থাভাজন প্রার্থীও আছেন।
এই যে ৪২টি আসনে নৌকা হেরে গেল, সেটি কি আওয়ামী লীগের পরাজয় নয়? অন্যদিকে দলীয় নেতৃত্ব জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের শরিকদের ছেড়ে দেওয়া আসন থেকে নৌকা প্রার্থীদের প্রত্যাহার করার নির্দেশ দিয়েছিলের। দলীয় প্রার্থীরা বিনা বাক্য ব্যয়ে তা মেনেও নিয়েছেন। আবার এসব আসনে দলের মনোনয়ন না পাওয়া নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতারও সুযোগ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। এর মাধ্যমে তঁারা জোট শরিকদের যেমন ধাপ্পা দিয়েছেন, তেমনি নৌকা প্রত্যাহার করা প্রার্থীদের প্রতিও অবিচার করেছে।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি