নির্বাচন এলে জাতীয় পার্টি সংকটে পড়ে। বিগত জাতীয় নির্বাচনগুলার আগে এবং পরে এমনটাই দেখা গেছে। এবারও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে হঠাৎ করে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল ডাকায় নতুন করে সংকট দেখা দিয়েছে। সংকট তীব্র হয়ে উঠে, যখন পাল্টাব্যবস্থা হিসেবে রওশনকে বাদ দিয়ে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা করার প্রস্তাব দিয়ে চিঠি দেওয়া হয় স্পিকারের কাছে। আবার রওশন এরশাদও কাউন্সিল করা নিয়ে নিজের অবস্থানে অটল।
জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতাদের ভাষ্য, দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকেই দলটির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয় এবং তা আজও অব্যাহত আছে। দলের সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে বারবার অদৃশ্য সুতায় টান দিচ্ছে তৃতীয় একটি পক্ষ। নির্বাচন এলে তৃতীয় পক্ষ তৎপর হয়ে উঠে বলে। তবে নেতারা কৌশলগত কারণে তৃতীয় পক্ষের নাম বলতে রাজি নন।
এর ২০১৪ সালের নির্বাচনে নানা সমীকরণ তৈরি হলে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচন বর্জন করেন। অন্যদিকে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন এবং জাপা থেকে ৩৪ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই সংসদে বিরোধদলীয় নেতা হন রওশন এরশাদ। উপনেতা হন জি এম কাদের। ওই নির্বাচনে আগে তার রহস্যজনক অসুস্থতা ও সিএমএইচে ভর্তি থাকা নিয়ে সারা দেশে আলোচনার সৃষ্ট হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে এরশাদ সিএমএইচ থেকে সরাসরি বঙ্গভবনে যান শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে।
২০১৮ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০১৬ সালে জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করা নিয়ে বেশ সংকটে পড়ে জাতীয় পাটি। একপর্যায়ে রওশনকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এরশাদ। পরে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। উপনেতা বানান ছোট ভাই জি এম কাদেরকে। এর কিছুদিন পরেই জি এম কাদেরকে সরিয়ে পুনরায় উপনেতা বানান স্ত্রী রওশন এরশাদকে। এরশাদ মারা যাওয়ার পর জি এম কাদের দলের চেয়ারম্যান হন। কিন্তু রওশনের সঙ্গে তার বিরোধ মেটেনি।
দলটির ইতিহাস থেকে জানা যায়, ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতন হয়। এর পর থেকে আজ পর্যন্ত অনেক ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে গেছে দলটি। এই ভাঙা-গড়ার কাজটিও জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিংবা দলীয় নেতা নির্বাচনের জের ধরেই হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
আর এভাবেই পর্যায়ক্রমে জাতীয় পার্টি (জাপা) ভেঙে ছয়টি দলে ভাগ হয়ে আছে। ছয়টি দল হলো- বর্তমানে জি এম কাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা), আনোয়ার হোসেন মঞ্জু নেতৃত্বাধীন জেপি, আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বিজেপি, ডা. মতিনের নেতৃত্বাধীন বিজেপি, মোস্তফা জামান হায়দারের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ও সর্বশেষ এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (পুনর্গঠন)। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি (জি এম কাদের), জেপি (মঞ্জু), বিজেপি (পার্থ), জাতীয় পার্টি (ডা. মতিন)-এই চার দলের নিবন্ধন রয়েছে। জেপি (মঞ্জু) বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন চৌদ্দ দলের অন্যতম শরিক। বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা আন্দালিব রহমান পার্থ’র বাবা নাজিউর রহমান মঞ্জু। নাজির রহমান মঞ্জুর সঙ্গে মহাসচিব ছিলেন বর্তমানে জি এম কাদেরের সঙ্গে থাকা জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান সাবেক ছাত্রলীগ নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ। বিজেপি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে থাকলেও পরে বের হয়ে যায়। মোস্তফা জামান হায়দার যে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, এই দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত কাজী জাফর উল্লাহ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় পার্টির একজন কো-চেয়ারম্যান আমাদের সময়কে বলেন, এরশাদ-পরবর্তীতে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন বা আছেন তাদের প্রত্যেককে এ দেশের জনগণ দেখেছে। ফলে স্বৈরশাসকের তকমা এখন আর শুধু এরশাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরং দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, শিল্প-সংস্কৃতি ও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের জন্য এরশাদ তথা জাতীয় পার্টিও ভূমিকা অনেক। তাই মানষের কাছে জাতীয় পার্টির ইমেজ অনেক ভালো। আর এ কারণেই জাতীয় পার্টিকে অনেক অদৃশ্য শক্তি নিজের মতো করে পেতে চায়। এরই অংশ হিসেবে নির্বাচন এলেই নানা নাটক ও জটাজাল দলটির সামনে আসে।
জাতীয় পার্টি-পুনর্গঠন নাম দিয়ে বিদিশা সিদ্দিকের তৎপরতা লক্ষণীয়। এরশাদ মারা যাওয়ার পর তিনি এরশাদের বাসভবন প্রেসিডিন্টে পার্কে এসে ওঠেন। তার দাবি ছিল এরশাদের স্ত্রী হিসেবে নয়, তিনি এরিকের মা হিসেবে ওঠেন। এ সময় জি এম কাদেরসহ জাপার কিছু নেতা প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছিলেন। তাদের ভাষ্য ছিল, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রেখে যাওয়া বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও ট্রাস্টের অর্থ লোভে বিদিশা প্রেসিডিন্টে পার্কে এসেছেন। তবে মায়ের প্রতি এরিকের আবেগপূর্ণ বক্তব্য ও দৃঢ়তার কারণে জাপার নেতারা বিদিশার প্রসঙ্গ এড়িয়ে দলের প্রতি মনোযোগী হতে দেখা গেছে।
তবে বিদিশা এরপর থেকে থেমে থাকেননি। জাতীয় পার্টিতে প্রাথমিক সদস্য না থাকলেও এরিক ও রওশনপুত্র শাদকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় পার্টি-পুনর্গঠন নামে আরেকটি দল গঠন করে কাজ করছেন তিনি। এ দলের চেয়ারম্যান করা হয়েছে বেগম রওশন এরশাদকে। রওশনের পক্ষে বা বিপক্ষে এখন পর্যন্ত কোনো বক্তব্য-বিবৃতি দেননি। অথচ তিনি জি এম কাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আছেন।
দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রয়াণের পর স্বামী শোকে দীর্ঘদিন একাকিত্বে কাটিয়েছেন রওশন এরশাদ। এর সঙ্গে যুক্ত হয় শারীরিক জটিলতা। খুব বেশি অসুস্থ হলে তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স করে থাইল্যান্ড নেওয়া হয়। সেখানে জি এম কাদেরসহ অন্য নেতারাও যান। সাত মাস চিকিৎসা শেষে গত জুন মাসের শেষ সপ্তাহে তিনি দেশে ফেরেন। ওইদিন তাকে স্বাগত জানাতে যান জিএম কাদেরসহ দলের বিভিন্ন নেতারা। জুলাই মাসের শুরু কৃতজ্ঞতা ও অনুভূতি ব্যক্ত করতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন রওশন এরশাদ। কিন্তু এরপর কিছুদিন থেকে আবার থাইল্যান্ডে চলে যান তিনি। বর্তমানে সেখানেই আছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে তিনি আগামী ১০ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরবেন।
থাইল্যান্ডে বসেই রীতিমতো ‘বোমা’ ফাটান রওশন। গত ১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় হঠাৎ রওশন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি যায় গণমাধ্যমে। আগামী ২৬ নভেম্বর একটি সম্মেলনের আহ্বান করেন। সেখানে নিজেকে তিনি সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক করে আট সদস্যের কমিটি ঘোষণা করেন, যাতে দলের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে (জিএম কাদের) রাখা হয়নি। তখন চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে বলা হয়, কাউন্সিল ডাকার এখতিয়ার প্রধান পৃষ্ঠপোষকের নেই। এর পর চেয়ারম্যানের পক্ষে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে চিঠি দিয়ে দলের বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে (জিএম কাদের) বিরোধীদলীয় নেতা করার প্রস্তাব করা হয়। চিঠিতে ২৬ এমপির মধ্যে ২৩ জনেরই স্বাক্ষর রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গতকাল সকালে দলটির সভাপতিম-লীর সভা হয়। এতে জি এম কাদেরকে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা করতে সমর্থন জানানো হয়।
জাতীয় পার্টির বর্তমান সংকট প্রসঙ্গে জিএম কাদের বলেন, জাতীয় পার্টি এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত। গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণে এগিয়ে যাবে দলটি; কোনো ষড়যন্ত্রে মাথানত করবে না। তিনি বলেন, ‘বেগম রওশন এরশাদের নাম ব্যবহার করে তৃতীয় পক্ষ কোনো একটা এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। তিনি আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র, তিনি আমাদের শ্রদ্ধার আসনেই আছেন। তবে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা দলের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র সফল হতে দেবে না।’