নির্বাচনের এখনো অনেক দেরি, এখনই নির্বাচন নিয়ে সঙ্ঘাতে লিপ্ত হওয়ার অর্থ হলো- জনগণের বর্তমান দুঃখ-দুর্দশা আড়ালে ঠেলে দেয়া। জনস্বার্থের রাজনীতির অবর্তমানে ব্যবসায়ী মানসিকতার ভাগবাঁটোয়ারাকে আর যাই হোক রাজনীতি হিসেবে গণ্য করা যায় না।প্রধান বিরোধী পক্ষ বিএনপি ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, সংসদ বহাল রেখে বর্তমান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠেয় আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে না। গতবারের মতো শেষ পর্যন্ত এটি যদি কৌশলগত সিদ্ধান্ত হয়; তাহলে নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে কথা বলার কোনো অর্থ হয় না। নির্বাচন কমিশন আসলে একটি ঠুঁটো জগন্নাথ, যাকে সামনে রেখে নির্বাচন পরিচালনা করবে সরকার। একই সাথে সরকারি দলের বিজয় থাকবে তাদের হাতের মুঠোয়। স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সদিচ্ছা যদি নির্বাচন কমিশনের থাকত তাহলে তার জন্য ভারতের দৃষ্টান্ত দেখানো সহজ ছিল, যেখানে সাধারণ নির্বাচনের আগে পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। এখানেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয় মনে করতে হবে। যখন অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো সুযোগ নেই; তখন মেশিনে ভোট গ্রহণের বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সাথে মতবিনিময় ও বিতর্ক করা অর্থহীন। রাজনীতিতে এটিই শেষ কথা যে, সরকার যদি শান্তিপূর্ণ পথে ক্ষমতার পালাবদলের ব্যবস্থা না রাখে, তাহলে তাকে বিকল্প পন্থায় মোকাবেলা করতে হবে। সেই আলামত একটু একটু করে দৃশ্যমান হচ্ছে। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচন দেয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
পুলিশি মামলাসহ সর্বতোভাবে রাজনীতি করা যে কঠিন ও অনিরাপদ করে তোলা হয়েছে; এটি সরকারকে বোঝানো যাচ্ছে না। রাজনীতিও রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার লোকদের কাছে থাকছে না। রাজনীতি এখন ভাড়াটে লাঠিয়াল ও বন্দুকধারীদের বিষয় হয়ে গেছে। রাজনীতির জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন পড়ছে না। চারিত্রিক গুণাবলি তো দূরের কথা। কোনো সভ্য ও শিক্ষিত জাতির জন্য এর চেয়ে বেশি লজ্জার আর কিছু হতে পারে না। সরকারের আর্থিক দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় জনজীবনে যে দুঃখ-কষ্ট ও বেকারত্ব দেখা দিয়েছে, তা নিয়ে বিরোধীপক্ষকে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করতে হবে। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তখন জনগণও আর বিচ্ছিন্ন থাকবে না। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের ওপর জনগণের যে আস্থা নেই, তা কারো অজানা নয়। তাই জনগণের বাঁচা-মরার প্রশ্নে তাদের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। বর্তমান সময়ে সাধারণ নাগরিক অনেকের জীবন-ধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে, নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা তাদের। সরকারি দলের চাঁদাবাজদেরও খুশি করতে হচ্ছে অসহায় জনগণকে। দল বেঁধে ধর্ষণসহ একের পর এক অপরাধ করে যাচ্ছে সরকারি দলের পাণ্ডারা। অনেক বিশ^বিদ্যালয়ে টর্চার শেল গড়ে তোলা হয়েছে। পুলিশ যদি নির্যাতনকারীদের সহযোগী না-ও হয়, তবু নির্যাতনের শিকার যারা হচ্ছেন তাদের সাহায্য করার আগে দু’বার ভাবতে হচ্ছে। বস্তুত, পুলিশকে নির্লজ্জভাবে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করছে ক্ষমতাসীন দল। আর এটি করতে গিয়ে রাজনীতি হচ্ছে বিতর্কিত ও পুলিশের পেশাগত সুনাম বহির্বিশ্বে ম্লান হচ্ছে।
পুলিশের নির্লিপ্ততার সুযোগ নিয়ে যারা অপরাধ সংঘটনের মাধ্যমে দুর্বিষহ করে তুলছে জনজীবন, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, পুলিশের সাথে সঙ্ঘাতে জড়িয়ে তাদের নিবৃত্ত করা যাবে না। সরকারের ছত্রছায়ায় বেকার তরুণদের এখন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালানো ও অর্থ উপার্জনে ব্যবহার করা সহজ। বাস্তবে এভাবে অপরাধের বিস্তার ঘটছে এবং অপরাধীর সংখ্যা দিন দিন ব্যাপক হারে বাড়ছে। রাজনৈতিক দলের নেতাদের অবশ্য এ কথা বুঝতে হবে যে, জনগণ এখন আর তাদের বন্ধু ভাবে না। তাই দলকে ব্যবসায়ীদের আখড়া না বানিয়ে জনগণের পার্টি করতে হবে। প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে ভোটডাকাতি করতে দিয়ে বিরোধী নেতারা কিভাবে অর্থ কামিয়েছেন সে খবর জনগণ জানে। এর সাথে সঙ্গতি রেখে বিরোধীরা সরকারের দেয়া উপঢৌকন হিসেবে পাওয়া আসনে নির্লজ্জের মতো অনির্বাচিত সংসদে যোগদান করেছেন।
অবাধ নির্বাচনে সরকারের ভরাডুবি হবে, বিষয়টি সরকারও জানে। আন্তর্জাতিক সমর্থনে যদি স্বচ্ছ নির্বাচনের ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছানো যায়, তাহলে সরকার ক্ষমতা ছাড়তে আগ্রহী হবে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যাবে; শুধু অবাধ নির্বাচন কি অর্থ কামানোর রাজনৈতিক ব্যবসায় গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবে! জনগণ এ মুহূর্তে নানাবিধ জরুরি সমস্যার প্রতিকার চাইছে। নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দামে অনেকের ক্রয়ক্ষমতা নাগালের বাইরে চলে গেছে। জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবার মূল্য সরকার বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ওপর অপরাধ বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। নাজুক অর্থনীতির কারণে অনেকের ব্যবসায় বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন আয়ের সুযোগ নেই বললেই চলে। ভাগ্যাহত মানুষের জীবনযাপন হয়ে উঠেছে কঠিন থেকে কঠিনতর, সাথে সাথে অমানবিক।
ব্যবসায়ী ও অন্যদের কাছ থেকে সরকার বর্ধিত রাজস্ব আদায়ে বড় বেশি অসহনীয় ও নিষ্ঠুরভাবে চাপ সৃষ্টি করছে, তা সবার জন্য জীবন-মরণ সমস্যা সৃষ্টি করছে। কর পরিশোধের পর অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের কৌশল ও অসাধারণ ক্ষমতা দেখানো হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে। সরকারি করপোরেশনগুলোর কাছে বিপুল অঙ্কের ট্যাক্স বকেয়া পড়ে রয়েছে; কিন্তু তা পরিশোধ করার কোনো অর্থ নেই এবং তাদের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়েও নেই কোনো উদ্বেগ। সত্য হলো- লুটেরা গোষ্ঠীকে সরকার সুরক্ষা দিচ্ছে। জনগণের লুণ্ঠিত অর্থ অবশ্যই ফেরত দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় অর্থ, মানে জনগণের অর্থ চুরি করে তারা নিরাপদে শানশওকতে জীবনযাপন করছে। এ চুরির টাকা জনগণের ভোট চুরির কাজে বিলি-বণ্টন করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্য দিকে, অভিযোগ রয়েছে, বিরোধী দলগুলো হয়তো এ জন্য জনস্বার্থের সাথে সম্পৃক্ত এমন একটি বিষয় অবজ্ঞা করে যাচ্ছে। জনগণ গুরুত্ব পাচ্ছে না। যদি সত্যিকার পরিবর্তন আসে তবে আমরা জানতে পারব, কিভাবে রুশ ধাঁচের অলিগার্ক অর্থাৎ বিত্তবান লোক তৈরি করে তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকার ব্যবস্থা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভোটডাকাতির ব্যাপারে দর-কষাকষির প্রক্রিয়ায় শক্তির সমাবেশ ঘটানোর লক্ষ্যে নির্বাচনী মোর্চা করতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেনদরবার শুরু হয়েছে। অনির্বাচিত ও জবাবদিহির দায়মুক্ত বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে সংসদীয় আসনগুলোর জন্য অর্থ ঢালা হবে।
সরকার আমাদের ধোঁকা দিতে পারলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ধোঁকা দিতে পারবে না। তারা সরকারের চরিত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আমরা সহ্য করি, তাই তারাও সহ্য করে। অন্যায্য সুবিধা আদায় করতে পরাশক্তিগুলোও অনির্বাচিত সরকারকে ব্যবহার করে। জনগণের শক্তিতে বলীয়ান না হয়ে সরকার নির্ভর করে বিদেশী শক্তির ওপর। বিদেশী শক্তি পীড়াপীড়ি করলে বাংলাদেশেও অবাধ নির্বাচন হতে পারে। অবশ্য সরকারের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতিনির্ভর ব্যবস্থাপনার কাঠামো ভেঙে পড়ায় ক্ষমতাসীনদের পতন হতে পারে। তাই শিক্ষিত ও সচেতন লোকেরা ঘুমিয়ে থাকলে বিপদ তাদের ওপরও আপতিত হবে।
লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট