নানা পদক্ষেপ নেয়ার পরেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো যাচ্ছে না। বরং দিন দিন কমে যাচ্ছে। চলতি সপ্তাহেই আরেক দফা কমে যাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় আগামীকাল সোমবার পরিশোধ করতে হবে প্রায় ১.০৫ বিলিয়ন ডলার। পাশাপাশি বিপিসির জ্বালানি তেল, বিসিআইসির সারসহ সরকারের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানি ব্যয় মেটাতে সরকারি ব্যাংকগুলোকে রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ চলমান রয়েছে। গত বৃহস্পতিবারও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হয়েছে ৫ কোটি ২৯ লাখ ডলার। সবমিলে চলতি অর্থবছরে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রি করেছে ১০.০৫ বিলিয়ন ডলার। আকুর দায় পরিশোধের পর চলতি সপ্তাহেই রিজার্ভ কমে ৩১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসবে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রাতহবিল আইএমএফের হিসেবে রিজার্ভ ২৩ বিলিয়নের ঘরে নেমে যাবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যেমন স্বল্প মেয়াদি আমদানি ব্যয় পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। গ্রিন ট্রান্সফারমেশন ফান্ড বা জিটিএফ থেকে অর্থ ছাড় সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। এ তহবিল থেকে বৈদেশিক মুদ্রা তথা ডলার ও ইউরোর মাধ্যমে অর্থ ছাড় করা হয়ে থাকে। পাশাপাশি রফতানি উন্নয়ন তহবিল বা ইডিএফ বিকল্প ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়েছে। এ তহবিল থেকে রফতানিকারকরা স্থানীয় মুদ্রায় স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে ডলার কিনে ব্যাক টু ব্যাক এলসির দায় পরিশোধ করতে পারবেন।
যা আগে ইডিএফ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় সরবরাহ করা হতো। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া বিলাসী পণ্যসহ অন্যান্য পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। একই সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে তদারকি করা হচ্ছে। প্রথমে ৫০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবহিত করতে হতো। পরে তা আরো কমিয়ে ৩০ লাখ ডলারে নামিয়ে আনা হয়। পণ্য আমদানিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি জোরদার করায় কমে গেছে এলসির পরিমাণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ২০২১ সালে পণ্য আমদানির প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যেখানে ৫৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ, আর গত ডিসেম্বরে তা কমে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ২৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে প্রকৃত আমদানি কমেছে প্রায় ৮৫ শতাংশ। এর পরেও জুলাই থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৮ মাস ২ দিনে বাংলাদেশ ব্যাংক তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে ১০.০৫ বিলিয়ন ডলার। গত বৃহস্পতিবারও বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হয়েছে ৫ কোটি ২৯ লাখ ডলার।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, আগে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সব ধরনের ব্যাংকের পণ্য আমদানির জন্য ডলার সঙ্কট দেখা দিলে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতো। কিন্তু এখন শুধু সরকারি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য যেমন সার, জ্বালানি তেল, বীজসহ প্রয়োজনীয় পণ্য কেনাকাটার জন্য সরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। অন্য ব্যাংকগুলো ডলার সংস্থান করতে না পারায় গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় এলসি খুলতে পারছে না। এর অন্যতম কারণ হিসেবে ব্যাংককাররা মনে করছেন বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ একটি ভালো অবস্থানে ধরে রাখা। কিন্তু নানা পদক্ষেপ নেয়ার পরেও রিজার্ভ বাড়ানো যাচ্ছে না। বরং কমে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত তিন জানুয়ারি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩৩.৭৮ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু আকুর দায় পরিশোধের পর তা ৩২ বিলিয়নের ঘরে নেমে যায়। ওই সময় আকুর দায় পরিশোধ করা হয় সোয়া বিলিয়ন ডলার। জানা গেছে, প্রতি দুই মাস পরপর আকুর দায় পরিশোধ করতে হয়। আকু হলো আন্তঃদেশীয় এক লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। আকুর মাধ্যমে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার লেনদেনের দায় পরিশোধ করা হয়। ইরানের রাজধানী তেহরানে আকুর কেন্দ্রীয় কার্যালয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত জুলাই-আগস্ট ১.৭৩ বিলিয়ন ডলার আকুর দায় পরিশোধ করতে হয়। আর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর আমদানি দায় পরিশোধ করতে হয় ১.৩৫ বিলিয়ন ডলার। আর নভেম্বর-ডিসেম্বরের জন্য পরিশোধ করা হয় সোয়া বিলিয়ন ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি জোরদার ও ব্যাংকগুলোর ডলার সঙ্কটে প্রয়োজনীয় এলসি খুলতে না পারায় আকুর দায়ও কমে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির আকুর দায় আগের দুই মাসের চেয়ে কমে পরিশোধ করতে হবে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার। আকুর দায় পরিশোধ করতে হবে আগামীকাল ৬ মার্চ সোমবার। ৭ তারিখে তা সমন্বয় হবে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরো কমে ৩১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে যাবে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া বিলাসী পণ্য আমদানি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ডলার সংস্থান করতে না পারায় শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও আগের মতো ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করা হচ্ছে না। সবমিলেই এলসি খোলার হার অর্ধেকে নেমে গেছে। এর পরেও ডলার সঙ্কট কাটছে না। বকেয়া পণ্য আমদানির দায় পরিশোধ করতে সামনে আরো চাপ বাড়বে। যে হারে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় আসছে তাতে চাহিদার চেয়ে ঘাটতি থাকবে। এ কারণে সামনে ডলার সঙ্কট কাটবে না বরং বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।