মানুষের জীবনে অর্থবিত্তের প্রয়োজনকে অস্বীকার করা যায় না। ঠিক কত পরিমাণ অর্থবিত্ত থাকলে জীবন স্বাচ্ছন্দ্যে কেটে যাবে তা কেউ বলতে পারে না। তাই কিছু মানুষ বুভুক্ষের মতো সঞ্চয় করে। কারো পৈতৃক সূত্রেই প্রচুর সহায়সম্পত্তি থাকে, সেই সাথে স্বোপার্জিত সম্পদ যোগ হয়। ব্যক্তির মৃত্যুর পরও কয়েক পুরুষ যেন অভাবগ্রস্ত না হয় সে জন্য কারো কারো চেষ্টার শেষ নেই।
বার্ধক্যে মৃত্যু মানুষের কামনা। প্রচুর সম্পদ বার্ধক্যকালে কাজে না লাগলেও সন্তানদের মনোযোগ ও সেবা-শুশ্রূষার প্রাপ্তি প্রত্যাশা করা স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতার ব্যত্যয় ঘটে মাঝে মধ্যে। দেখা যায় বার্ধক্যকবলিত মানুষটির সম্পদ বাটোয়ারা আর অধিকার নিয়ে সন্তানদের দড়ি টানাটানির মধ্যে পড়ে ব্যক্তিটির জীবিতকালই হয়ে ওঠে বিষময়।
বাংলাদেশের একজন নামকরা অধ্যাপকের কথা পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছিল। তিনি অকৃতদার ছিলেন। শেষ বয়সে তার অর্জিত সম্পদের জন্য ভাতিজারা তাকে গৃহবন্দী করেছিল। পাগল রটিয়ে তাকে কারো সাথে কথা বলা বা দেখা-সাক্ষাৎ করতে দেয়া হতো না। ওই অবস্থায় একদিন চুপিসারে তার মৃত্যু হয়।
একজন নামকরা সাবেক মন্ত্রী এবং বর্তমানে মৃত, তারও এই দশা ঘটে যে, তিনি নিজের বিলাসবহুল বাড়িতে ঠাঁই পাচ্ছিলেন না। তার পুত্রই তাকে বাড়িতে উঠতে দেয়নি। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তিনি নিজের করা বাড়িতে উঠতে পেরেছিলেন।
আরেকজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ দুই স্ত্রীর সন্তানদের গ্যাড়াকলে পড়ে বড় অসুবিধায় আছেন। একপক্ষের ছেলেরা অভিযোগ করেন, অন্যপক্ষের ছেলেরা তাকে করায়ত্ত করে ‘জিম্মি’ করে ফেলেছে। ওই রাজনীতিবিদ বর্তমানে বার্ধক্যকবলিত। তার বিপুল সহায়সম্পদ নিয়েই মূলত তুমুল বিবাদ। কে কী পাবে এই নিয়ে সৃষ্ট জটিল পরিস্থিতিতে বড় বিপদে আছেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ।
সন্তানদের সম্পদের লোভ-লালসায় কত মানুষ জীবন দেয় তা বলে শেষ করা যাবে না। বৃদ্ধ মা-বাবাকে পিটিয়ে জখম, আঘাতে মেরে ফেলা, রহস্যজনক আগুনে মৃত্যু- এগুলো এ সমাজে আছে যা মাঝে মধ্যে পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়। এ ছাড়া বোন-ভাই বা অসহায় জনকে পাগল সাজিয়ে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে আর খোঁজখবর না নেয়ার ঘটনার কথাও জানা যায়। সহায়সম্পদ আত্মসাতের জন্যই বেশির ভাগ ঘটনা ঘটে।
আমাদের এলাকায় দীর্ঘ দিন আমি এক পাগল দেখেছি, তার থাকার জায়গা ছিল এক বাড়ির সামনে ফুটপাথে। লোকের কাছে শুনেছি, তার খালার বাসা এই এলাকার কাছে। ওই খালা তাকে কুফরি কালাম করে তার জমিজমা আত্মসাৎ করেছে। সহায়সম্পদ হারিয়ে এখন সে উন্মাদ, পাগল।
অনেকদিন এলাকাতে একজন পাগলি ছিল। এই এলাকাতে তার পৈতৃক চারতলা বাড়ি। শোনা গেছে, ভাইবোনেরা তাকে সম্পদ বঞ্চিত করায় সে পরান্নভোগী, রাস্তার পাগল।
বিপুল সম্পদের মোহে মানুষ নদী দখল করে, পাহাড় কাটে, অন্যের জমি দখল করে, বন সাফ করে, সরকারি জমি দখল করে তাদের কী হয়? এক জীবনে সব খেয়ে যেতে পারে না। পরবর্তী প্রজন্মে এই সম্পদ কিভাবে কাজে লাগে গবেষণার বিষয়।
মানুষের সহায়সম্পদ কম থাকলে বৃদ্ধকালে অসহায়ত্বের শেষ থাকে না। সন্তানাদির অনাস্থা-অবহেলায় দিন কাটে। অর্ধাহারে, অনাহারে বিনা চিকিৎসায়, সেবা যত্নের অভাবে শেষ দিনগুলো ফুরিয়ে যায়। অনেকের জীবিতকালের রোজগার আত্মীয়স্বজন ভোগ করে বৃদ্ধকালে তাকে ছুড়ে ফেলে দেয়।
ধনী বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কাজের মানুষ পরিবেষ্টিত রেখে বা হাসপাতালে দিনের পর দিন ভর্তি রেখে কাছের মানুষেরা ব্যস্ত দিন অতিবাহিত করে বা প্রবাসী সন্তানরা কেয়ারটেকার রাখে। জীবন পাল্টে গেছে। খুব দ্রুতই সমাজ ইংল্যান্ড, আমেরিকা বা উন্নত দেশের মতো ব্যস্ত জীবনে পরিবারকে সময় দেয়ার ‘সময়’ থেকে ছুটি নিচ্ছে।
সহায়সম্পদ নিয়ে মারামারি, খুনোখুনি, মামলা-মোকদ্দমা এই সমাজের কালচার। এক জরিপে জানা গিয়েছিল, উত্তরবঙ্গে জমিসংক্রান্ত মারামারি, খুনোখুনির সংখ্যা বেশি; সে কারণে সেখানে ওকালতি ব্যবসার প্রসারও বেশি। উকিলের পেছনে সময় ও অর্থ ব্যয় করতে করতে অনেকের সংসার উচ্ছন্নে যায় আর মামলার খরচে জমিজমা বিক্রি করে ফতুরও হয়ে যায়। দীর্ঘ বছরগুলোর পর হয়তো দেখা যায়, মামলায় হেরে তারা নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছে।
একজনের আছে, অন্যজনের নেই বা কম আছে- এমন লোকদের মধ্যে একশ্রেণী অন্যের বা আত্মীয়ের সম্পদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই হিংসা থেকেই মূলত দখল, বেদখল, চুরিচামারি, ডাকাতি, অপহরণ, খুন, ধর্ষণ। প্রবাসী দেশে ফিরেছে, শত্রুপক্ষ তাকে খুন করছে, কারো দিন ভালো চলছে, তার বাড়িতে ডাকাত পড়ছে, প্রবাসীর সন্তান অপহরণ করে খুন করা হচ্ছে, মেয়েকে অপহরণ করা হচ্ছে- প্রবাসীর স্ত্রীকে বাড়িছাড়া করা হচ্ছে- এগুলো মানব মনের হিংসা থেকেই হচ্ছে। উল্লেখযোগ্য সম্পদ ডেকে আনে বিপদ। এই বিবাদ একদল মানুষসংশ্লিষ্ট।
রিটায়ারমেন্টে যাওয়া কয়েকজন উচ্চশিক্ষিত পদধারী জীবনের সঞ্চয়ে বাড়ি করতে গিয়ে সাম্প্রতিককালে খুন হয়েছেন। এর মধ্যে একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও অধ্যাপিকাও আছেন। প্রবাসী সন্তানের নিঃসঙ্গ পিতা-মাতারাও দেশে নিরাপদ আছেন বলা যায় না। নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ নারী বা পুরুষ কাজের লোক বা কাছের মানুষের সম্পদের লোভের শিকার হচ্ছেন বেশি, জীবন দিয়েই তাদের প্রায়শ্চিত্ত ঘটছে।
দেশে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে তত্ত্বতালাশের কেউ না থাকায় নিরাপত্তার প্রশ্নে অনেকে পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আবার যেসব পিতা-মাতা সন্তানকে নির্দয় নিষ্ঠুর আচরণ করে বড় করেছেন তাদেরও ঠাঁই হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে।
কোনো কোনো ধনাঢ্য ব্যক্তি অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে ঠাঁই দিতে গ্রামেও বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করেছে। সেখানে সমস্যাগ্রস্ত, অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থাকতে পারেন। এখানে চিকিৎসা, সঙ্গ, সেবা, খাদ্য পাওয়া যায় বিধায় ভিটেমাটিহীন অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা আশ্রয়ও নেন।
আমি এখানে গ্রামের দু’টি পরিবারের কথা স্মরণ করব, যারা দরিদ্র হলেও অসহায় মাকে দূরে ঠেলেননি। খুব কাছে, যতদূর পারা যায়, যত্নে রেখেছিলেন।
এক. মোটামুটি গৃহস্থ সাত-আটটি অপগণ্ড সন্তান ও স্ত্রীকে রেখে যখন যক্ষ্মায় মারা গেলেন তখন তার কোনোক্রমে অর্ধচিকিৎসা শেষে রইল ভিটাটুকু। দিশেহারা স্ত্রী অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে ছেলেমেয়েগুলোকে পরের বাড়িতে কাজে লাগিয়ে দিন গুজরান করতে লাগলেন। একসময় ছেলেরা কর্মক্ষম হয়ে সংসারের হাল ধরল। বোনদের বিয়ে দেয়া হলো। ওই ভিটাটুকু শেষ পর্যন্ত বিক্রি করতে হলো না। মাকে তারা সবাই দেখতে লাগল। এভাবে একদিন মায়ের মৃত্যু হলো। পরের কাহিনীও একই। দুই. তরুণী বধূ তার স্বামী বিয়োগে কয়েকটি কন্যাসন্তান নিয়ে মহাবিপাকে পড়ল। পরের বাড়ি কাজে লাগিয়ে বড় করে তুলল সন্তানদের। গ্রামেই বিয়ে দিলো। মেয়েরা যার যার সামর্থ্যমতো নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে কিছু রোজগার করে স্বামীর সংসার করতে লাগল। সকাল, সন্ধ্যা-রাত মেয়েরা তার দেখাশোনা করত পালা করে। বৃদ্ধ হয়ে তিনি মারা গেলেন শত দুঃখেও প্রশান্তি নিয়ে। এটাই চিরচেনা বাঙালি পরিবার। সন্তানাদির সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা থাকা। স্নেহ-বিগলিত সম্পর্কের অচ্ছেদ্য বন্ধন। এখানে অর্থবিত্তের মোহও ছিল না, হালাল উপার্জনে খুব বেশি সচ্ছল হওয়ার উপায় ছিল না। কিন্তু ছেলেময়েদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ জাগ্রত হয় না। কে বেশি দিলো আর কম দিলো, এ নিয়ে কোনো বাগি¦তণ্ডা হয়নি। সবাই এটাকে অসহায়, সংগ্রামী মায়ের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা আর মায়া হিসেবেই দেখেছে।
তারপরও বলতে হয়, ওই দুই মা তাদের সন্তানদের বিপথগামী হতে দেননি। তারা কেউ খারাপ নয়। কারো সাথে তাদের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত নেই, অভাবে ক্ষুধায় তারা পরদ্রব্য ছুঁয়ে দেখেনি। হাত পেতেছে, মানুষের খারাপ ব্যবহারের শিকার হয়েছে, আবার হয়তো কারো দয়াও পেয়েছে। এভাবে তারা সীমিত পরিসরে উঠে দাঁড়িয়েছে।
মানুষের মতো মানুষ হলে অনৈতিক পথে অঢেল সম্পদের প্রয়োজন নেই। আত্মতৃপ্তি নিয়ে মহান আল্লাহর ভরসায় থাকা মানুষগুলোই প্রকৃত মানুষ। এর জন্য শিক্ষা লাগে। একমাত্র পরিবার বা মাতা-পিতা থেকে এ শিক্ষার সূচনা।
মকবুলা পারভীনলে
লেখক : কথাশিল্পী, সাংবাদিক