বুধবার, ০৯:৫৯ অপরাহ্ন, ০৮ জানুয়ারী ২০২৫, ২৪শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

দ্বীনের ছায়ায় হোক উম্মতের আশ্রয়

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২৩
  • ৮৪ বার পঠিত

প্রেমপ্রীতি, সৌহার্দ, শান্তি ও সম্প্রীতির এক পরিমণ্ডল বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত করাই ইসলামের মূল লক্ষ্য। অন্য কথায়, মহান আল্লাহতায়ালার প্রতি বিশ্বস্ততার হক আদায়ে এবং তার সৃষ্টির প্রতি দায়বদ্ধ আচরণের মাধ্যমে এ বিশ্বকে এক স্বর্গ-রাজ্যে পরিণত করা।

ইসলামের আকর্ষণীয় শিক্ষার প্রচার ও প্রসার জোর-জবরদস্তি এবং বল প্রয়োগে নয় বরং সৌহার্দ ও সম্প্রীতি দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করার মাধ্যমে। বল প্রয়োগ করলে অন্যের অধিকার যেমন দেওয়া যায় না, তেমনি আল্লাহতায়ালার নৈকট্য-লাভও এর দ্বারা সম্ভব নয়।

কোনোভাবেই এ ধারণার উদ্রেক করা ঠিক হবে না যে, ইসলাম প্রচারে তরবারি প্রয়োগের নির্দেশ রয়েছে। ধর্ম-বিশ্বাসের বিস্তার ঘটাতে নিশ্চিতভাবেই তরবারি ব্যবহৃত হয়নি। শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য এটি ব্যবহৃত হয়েছিল, এটাই সত্য ইমানের বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে অবশ্যই এটি অর্থাৎ তরবারি কখনো ব্যবহৃত হয়নি। কারণ, ইমানি বিষয় তো মানব হৃদয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। ধর্মের টানে নিজেকে উৎসর্গ করতে হয়। মক্কার প্রথম তেরো বছর মুসলমানদের জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। এমনকি, মদিনায় হিজরত করার পরও শত্রুরা তাদের ওপর চড়াও হলে সম্পূর্ণ অসজ্জিত অবস্থায় থেকেও তাদের ফিরতি-যুদ্ধ করতে হয়েছে। চাপ প্রয়োগে মুসলমান হলে কেউ কি এমন কুরবানি করতে পারে?

অনেকে এ প্রশ্নও করে থাকে যে, ইসলাম অর্থ যদি শান্তিই হয়ে থাকে, তবে মুসলমানরা যুদ্ধ করেছে কেন? মুসলমানরা যুদ্ধ করার প্রথম উদ্দেশ্য ছিল আত্মরক্ষা করা। শত্রুরা সর্বদা উত্ত্যক্ত করেছে, করেছে আগ্রাসী-আক্রমণ, আর মুসলমানরা আত্মরক্ষা করতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল-নিরস্ত্র মুসলমানদের যখন অবলীলায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন অহেতুক এ রক্তপাত ঠেকাতে এবং নির্মম নিষ্ঠুরতার শাস্তি দিতে যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

আরবদের রীতি ছিল এটা, আর শান্তি বজায় রাখতে এর অবশ্য প্রয়োজনও ছিল এবং সে ধারা আজও সর্বত্র স্বীকৃত। তৃতীয়ত যুদ্ধ করা হলে তা করা হবে বিরোধীদের দুর্বল করতে, কেননা তারা একত্রিত হচ্ছে মুসলমানদের নির্মূল করতে, শুধু এ কারণে যে, তারা এক আল্লাহর ইবাদত করে। এ অবস্থায় যুদ্ধ করা না হলে কাফিররা একজন মুসলমানকেও বাঁচতে দিত না। মহান আল্লাহতায়ালা যথার্থই বলেছেন, ‘ঠেকানো না হলে তারা মঠ, মন্দির, গির্জা, সিনেগগ এবং মসজিদগুলোকে ধূলিসাৎ করবে আর নির্মম নিষ্ঠুরতা ক্রমেই বেড়ে চলবে।’

তবে এটা ঠিক যে, মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে যুদ্ধের প্রয়োজন কখনো ছিল না। ইতিহাস এ সাক্ষ্যই বহন করছে যে, মুসলমানরা কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে গেলেও কাউকেই মুসলমান হতে কখনো বাধ্য করা হয়নি। প্রত্যেক ব্যক্তিরই ইবাদতের স্বাধীনতা আছে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে মহানবি (সা.) সুনির্দিষ্ট করে বলে দিতেন যে, ‘বয়োবৃদ্ধদের, নারীদের এবং শিশুদের অনিষ্ট করবে না, আর উপসনালয়ের ক্ষতি সাধন করবে না।’ এমনকি বৃক্ষরাজি পর্যন্ত তিনি কর্তন করতে নিষেধ করেছেন।

মুসলমান দেশগুলোতে খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা যাতে তাদের অধিকার সঠিকভাবে ভোগ করতে পারে, সে জন্য অমুসলমানদের থেকে ‘জিজিয়া’ অর্থাৎ ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি কর’ নেওয়া হতো। আর কারও যদি তা দেওয়ার সামর্থ্য না থাকত, তবে তা আদায় করা থেকে তাকে অব্যাহতিও দেওয়া হতো।

ইসলামে মুসলমান ও অমুসলমানের সম-অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ইসলাম শত্রুদের সঙ্গেও দয়ার্দ্র আচরণ করে, তা শান্তিকালীনই হোক বা যুদ্ধাবস্থায়ই হোক। সর্বাবস্থায় ইসলাম অমুসলমানদের অধিকার মর্যাদার সঙ্গে সংরক্ষণ করে। ইসলাম একটি যুদ্ধংদেহী ধর্ম, এটি অপবাদ ও সর্বৈব মিথ্যা। বাস্তবতা হলো, কী পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছিল, যখন সর্বশক্তিমান আল্লাহ মুসলমানদের যুদ্ধের অনুমতি দিলেন?

মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তোমরা আল্লাহর পথে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর এবং সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৯০)। বিদ্বেষ ছড়ানো ও আক্রমণের অধিকার ইসলামে নেই। চড়াও হওয়া বা আক্রমণ করার অধিকার ইসলামে নেই। ইসলামের বাস্তব শিক্ষা হলো, কেবল আক্রান্ত হলেই তুমি যুদ্ধ করতে পার। অধিকন্তু, এখানে এ নির্দেশও রয়েছে যে, আক্রমণকারী বা আগ্রাসী হয়ো না, চুক্তি ভঙ্গকারী হয়ো না।

আমরা আজ এটাই দেখছি, সুন্দর-সাবলীল ও সুগঠিত এসব ইসলামী-শিক্ষার ওপর কোনো দলই আমল করছে না। আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীরা শিশু, নারী, বৃদ্ধ, নির্বিশেষে সবাইকে হত্যা করছে, অপরদিকে, আগ্রাসী বাহিনি, শহর-নগর-বন্দরে বোমা বর্ষণ করছে, গুলি চালাচ্ছে, করছে অতর্কিত আক্রমণ। তারা নগরগুলোতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে নগর-অবকাঠামো সমূলে বিনাশ করছে। এতে নাগরিক অধিকারের কিছুই আর অবশিষ্ট থাকছে না।

প্রতিটি বৃহৎ শক্তিই এখন পারমাণবিক বিপুল অস্ত্র সম্ভারের অধিকারী, এমনকি দরিদ্র-দেশগুলো পর্যন্ত অস্ত্র সম্ভার মজুতকরণের এ দৌড়ে শামিল হচ্ছে। মানবজাতি একেবারে ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে গেছে, যেখানে কিনা পবিত্র কুরআন আমাদের নিরপরাধ, নিরীহদের কোনো ক্ষতি না করার শিক্ষা দেয়, সেখানে পারমাণবিক-বোমার বিস্ফোরণ তাৎক্ষণিকভাবে জানমালের বিপুল ক্ষতি সাধন করা ছাড়াও শারীরিক প্রতিবন্ধিতা ঘটায়, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলতেই থাকে।

সুতরাং এটা তো হত্যা করার চেয়েও জঘন্যতর অপরাধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমা ব্যবহৃত হওয়ার পর মানুষ ভেবেছিল বিশ্ব এমন এক মারাত্মক মারণাস্ত্র বানানো থেকে হয়তো বিরতই থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো-সেসব অস্ত্রের প্রাণ-সংহারী ক্ষমতা বাড়াতে তারা আরও এগিয়ে গেছে। আর নিশ্চিতভাবেই বিশ্ব সামগ্রিক ধ্বংসলীলা সাধনকারী মারণাস্ত্রের উন্নত সংস্করণ উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতার দৌড়ে ছুটেই চলছে।

মূলত একজন মুসলমানের বিনা কারণে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার অনুমতি নেই, যদি না তা এমন লোকদের বিরুদ্ধে হয়, যারা আল্লাহর দ্বীন পালনে ও প্রচারে বাধা দেয় অথবা বিশ্বে শান্তি বিনাশের কারণ হয়। শান্তি বজায় রাখতে এটা অনুপম সৌন্দর্যমণ্ডিত শিক্ষা নয় কী?

আসলে ‘ইসলাম’-এর প্রকৃত-চেহারা বিকৃত করছে কতিপয় সন্ত্রাসী দল, তাদের সেসব কার্যকলাপ ইসলামের শিক্ষার সম্পূর্ণ পরিপন্থি, যদিও তারা ধর্মযুদ্ধের নামে হত্যাযজ্ঞ চালাতে পবিত্র কুরআনের সমর্থনের ধোঁয়া তুলে থাকে। কিন্তু তারা জিহাদের সঙ্গে অখণ্ডরূপে একাত্ম যেসব শর্তাবলি রয়েছে, সে বিষয়টি একেবারেই ভুলে যায়।

এ ছাড়া আত্মঘাতী হামলা চালানো পবিত্র কুরআন সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর ফলে বেসামরিক জনগণের জানমালের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়। সব ধর্মই শান্তি চায়, নৈরাজ্য বা সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মাধ্যমে ধর্মের সেবা হয় না। ধর্মের সেবা তখনই হয় যখন ধর্মীয় নিয়মকানুন মেনে সে অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা হয়।

আল্লাহতায়ালা সবাইকে প্রকৃত ইসলামের ছায়ায় জীবন অতিবাহিত করার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com