এক বন্ধুর সাথে অপর বন্ধুর দুষ্টামিটাও ছিল যেমন স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে, তেমনি খেসারাতটাও দিতে হল ভয়ঙ্কর কাদায়। মাঝখানে স্বজনকে ছাড়াতে গিয়ে ভিকটিম হলেন গৌরনদী পৌর বিএনপির আহবায়ক জাকির হোসেন শরীফ। পেলেন দলের কঠিন সিদ্ধান্ত। হারালেন পৌর বিএনপির আহবায়কের পদ। ঘটনাটি বরিশালের গৌরনদী উপজেলার টরকী বন্দরের।
জানাগেছে, ওই বন্দরের ফ্ল্যাক্সিলোড ও বিকাশ ব্যবসায়ী উপজেলার সুন্দরদী গ্রামের এ,কে,এম জামিল সিকদার ওরফে মিঠু সিকদার (৪৬)। একই সঙ্গে তিনি গৌরনদী পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারন সম্পাদক। ওই বন্দরে তার কাছাকাছি স্থানে একই ব্যবসা করতেন উপজেলার সাহাজিরা গ্রামের মোঃ নাজমুল হাসান মিঠু খান (৪৬)। তিনি রাজধানী ঢাকার তেজগাঁও কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী। প্রায় ২বছর হল মিঠু খান তার ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছে। ফলে এক সময় ব্যবসায়িক যোগাযোগ থাকলেও দীর্ঘ প্রায় দুই বছর তাদের মধ্যে কোন যোগাযোগ ছিলনা।
ঘটনার ভ‚ক্তভোগী এ,কে,এম জামিল সিকদার ওরফে মিঠু সিকদার জানান, গত ১৮ অক্টোবর বিকেল ৪টা ৫০মিনিটে ০১৭১৩৬৮৫২০৮ নম্বরের একটি অজ্ঞাতনামা মোবাইল ফোন থেকে আমার ০১৭১৫৫৭৫৫১৯১ নম্বরের মোবাইল ফোনে কল দিয়ে অজ্ঞাতনানা ব্যাক্তি বলেন, আপনি আর্মি ক্যাম্পে আসেন। আমি তখন ওই অজ্ঞাতনামা ব্যাক্তিকে বললাম আমি কি কাম করছি যে, আর্মি ক্যাম্পে আমি আসবো। স্যার আমিতো ফ্ল্যাক্সিলোডের দোকানদারী করে খাই। আসরের নামাজ পড়ে কেবল আসছি, এখন মাগরিবের নামাজ হবে। আমি এখন সন্ধ্যার সময় কি যাবো, আমি কালকে সকালে আসবো। আজকে হাটবার দিন, শুক্রবার আমাদের এখানে হাট হয়। এ কথা তাকে বলার পরে সে আমাকে বলে এ ব্যাটা তোর দোকানটাই বড়, দেখা কইরা যা। এ কথা শোনার পর আমি আমার বড়বোন ও ভগ্নিপতিকে নিয়ে ওইদিন রাতে উপজেলার কসবা গ্রামস্থ সেনা ক্যাম্পে যাই। সেখানে গিয়ে জানতে পারি তারা আমাকে ফোনে ডাকেনি। তখন অজ্ঞাতনামা ০১৭১৩৬৮৫২০৮ নম্বরটি সেনা ক্যাম্পে দেয়া হলে ক্যাম্পের একজন সেনা সার্জেন্ট ওই অজ্ঞাতনামা মোবাইল নম্বরে কল করে ওই ব্যাক্তিকে সেনা ক্যাম্পে আসতে বলেন। ফোনে তখন ওই ব্যাক্তি সেনা সার্জেন্টের সাথে দুর্ব্যাবহার করে। এর কিছুক্ষন পর অজ্ঞাতনামা ওই নম্বর থেকে আমাকে কল করে মোঃ নাজমুল হাসান মিঠু খান নিজের পরিচয় দিয়ে আমাকে বলে ভাই আমি তো আপনার সাথে একটু দুষ্টামি করেছি। আপনি এটার জন্য সেনা ক্যাম্পে বিচার দিলেন। এখন তো আমি বিপদে পড়ে গেলাম, আমাকে সেনা ক্যাম্পে দেখা করতে ডাকে। এই বলে সে আমার কাছে, আমার স্ত্রী ও বোনের কাছে ক্ষমা চায়। আমরা তখন তাকে ক্ষমা করে দেই।
গত ২২ অক্টোবর রাত সাড়ে ৮টার দিকে মিঠু খান ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইতে সেনা ক্যাম্পে যায়। এ সময় তাকে ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়। তখন নিজেকে ছাড়াতে সে আমাকে ফোন করে সেনা ক্যাম্পে যেতে বলে। আমি রাজি হইনি। এরপর গৌরনদী পৌর বিএনপির আহবায়ক মোঃ জাকির হোসেন শরীফের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে আটক মিঠু খানের খালাতো ভাই সজিব আমার কাছে এসে মিঠু খানকে ক্যাম্প থেকে ছাড়িয়ে আনতে যেতে অনুরোধ করে। তখন আমি সজিবকে সাথে নিয়ে মিঠু খানকে ছাড়িয়ে আনতে সেনা ক্যাম্পে যাই এবং তাকে ছেড়ে দিতে সার্জেন্টকে অনুরোধ করি। সার্জেন্ট এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে ও সজিব শরীফকে মারধর করে এবং সজিবকে ক্যাম্পে আটকে রাখে।
সজিব শরীফ সেনা ক্যাম্পে আটক এ খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান গৌরনদী পৌর বিএনপির আহবায়ক মোঃ জাকির হোসেন শরীফ ও তার চাচাতো ভাই পৌর বিএনপির সদস্য মোঃ ফরহাদ শরীফ। তারা নিজেদের পরিচয় দিয়ে সজিবকে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করেন। এতে ক্ষিপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যরা তাদেরকেও আটক করে। এর পর সেনা কর্মকর্তারা একটি এজাহার লিখে তাতে আমার স্বাক্ষর নিয়ে জাকির শরীফ, ফরহাদ শরীফ, সজিব শরীফ ও মোঃ নাজমুল হাসান মিঠু খানকে গৌরনদী থানা পুলিশের মাধ্যমে আদালতে সোপর্দ করে। পরদিন সকালে আদালতে গিয়ে আমি জাকির শরীফসহ সবাইকে ছাড়িয়ে আনি।
ভ‚ক্তভোগী এ,কে,এম জামিল সিকদার ওরফে মিঠু সিকদার বলেন, পৌর বিএনপির আহবায়ক মোঃ জাকির শরীফের সাথে আমার কোন ঝামেলা নেই। উনি একজন ভাল মানুষ, শুনেছি ঘটনা যাকে নিয়ে সেই নাজমুল হাসান মিঠু একজন নেশাখোর। তাই সে এমন পাগলামীটা করেছে। এ ঘটনায় আমি কোন মামলা করতে চাইনাই। তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য আমি বারবার সেনা কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেছি। তারা আমাকে বলেছে তুই এভাবে করলে তোকে মেরে তোর হাড্ডি-গুড্ডি ভেঙ্গে ফেলব। ভয়ে আমি আর কথা বলিনি। এজাহারে জাকির শরীফসহ গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে দেড় লাখ টাকা চাঁদার দাবীতে আমাকে মানরধরের অভিযোগ আনা হয়। তারা এজাহার লিখে এনে পড়ে শুনিয়ে আমাকে স্বাক্ষর দিতে বলেছে আমি স্বাক্ষর করে দিয়েছি। আসলে চাঁদাবাজীর কোন ঘটনা আমার সাথে ঘটেনি।
অপর দিকে এজাহারে উল্লেখিত অভিযোগের সুত্র ধরে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এ ঘটনার সংবাদ প্রচারিত হলে কোন প্রকার তদন্ত ছাড়াই বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর গৌরনদী পৌর বিএনপির আহবায়ক জাকির হোসেন শরীফ সদস্য ফরহাদ শরীফসহ তিন জনকে দল থেকে বহিস্কার করে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-দফতর সম্পাদক মুহাম্মদ মুনির হোসেন স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায় বহিস্কৃত তৃতীয় ব্যাক্তিটি হলেন বিএনপি কর্মী নাজমুল হাসান মিঠু। তার দ্বারাই ঘটনার সূত্রপাত।
ঘটনার সুত্রপাত যার মোবাইল ফোন কলকে কেন্দ্র করে, সেই নাজমূল হাসান মিঠু জানান, আমি আসলে বিএনপির লোক নই। আমি রাজধানী ঢাকার তেজগাঁও কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী। বর্তমানে প্রিন্টিং ব্যবসায় নিয়োজিত। বিএনপির প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেখে আমি হতবাক হয়েছি। আমি আওয়ামী লীগের লোক আর আমাকে বহিস্কার করে বিএনপি। এটা কি করে সম্ভব। তিনি প্রশ্ন রাখেন বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিস কোন প্রকার যাচাই বাছাই না করে এমন হাস্যকর কাজটি কিভাবে করল।
সেনা ক্যাম্পে আটক ও দল থেকে বহিস্কার হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গৌরনদী পৌর বিএনপির বহিক্কৃত আহবায়ক জাকির হোসেন শরীফ বলেন, সারা জীবন এ দলের জন্য শ্রম ঘাম ও রক্ত ঝড়িয়েছি, অসখ্য মামলার আসামী হয়েছি, একাধিক বার জেল খেটেছি, আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি। বিগত বিএনপি সরকারের আমলে ৫ বছর পৌরসভার কাউন্সিলর ছিলাম। কোনদিন আমার বিরুদ্ধে কেউ সন্ত্রাস বা চাঁদাবাজীর অভিযোগ আনতে পারেনি। একটি আওয়ামী লীগের ছেলের পাগলামীর কারনে সেনা ক্যাম্পে আটক ভাতিজাকে ছাড়িয়ে আনতে গিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চক্রান্তে আমার উপর সন্ত্রাস সৃষ্টি ও চাঁদাবাজীর কলঙ্ক দেয়া হল। দল সেটি ভালভাবে যাচাই-বাছাই না করে প্রতিপক্ষের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে আমাকে বহিস্কার করল। এ দুঃখ, এ কষ্ট রাখার যায়গা নেই। এখনও আমি দলের প্রতি অনুগত। আশা করছি দল ঘটনা তদন্ত করে এ ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত দেবে।
এ বহিস্কার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-দফতর সম্পাদক মুহাম্মদ মুনির হোসেন বলেন, তাকে বিএনপি বহিস্কার করেছে। সে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে ছিল এবং বিএনপির লোকের সাথে ছিল তারে তো এ জন্য আমরা কর্মী বলছি।
বিএনপির তার কর্মী সনাক্তে ভ‚ল করেছে কিনা ? এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা আমার জানা নেই, আমরা সনাক্ত করে বহিস্কার করেছি, আমিতো বহিস্কার করিনি, আমাদের দল বহিস্কার করেছে বলে কলটি কেটে দেন।