খেতেই পচছে কৃষকের তরমুজ। অকাল বৃষ্টিতে গোড়া পচে সৃষ্টি হয়েছে এই অবস্থার। মৌসুমের শুরুতেও এবার ভুগিয়েছে বৃষ্টি। অন্যান্য বছর পৌষ থেকে ফাল্গুনে কিছু বৃষ্টি হয় দক্ষিণাঞ্চলে। এই সময়ের বৃষ্টিতে বাড়ে তরমুজের ফলন।
কাঙ্ক্ষিত সেই বৃষ্টির দেখা মেলেনি এবার। ফলে মেলেনি আশানুরূপ ফলন। যেটুকু হয়েছে তাও এখন নষ্ট হচ্ছে। খেতে জমা পানিতে পচছে ফসল। এতে পথে বসেছে হাজার হাজার কৃষক। তাদের লাভ তো দূরের কথা উঠবে না খরচও। তাই তো কৃষকের চোখের পানিতে ভিজছে তরমুজের খেত।
গেল বছর সারা দেশে ৬৪ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছিল। এর মধ্যে বরিশালের ৬ জেলায়ই ছিল ৩৭ হাজার হেক্টর। ফলনও বাম্পার হয়েছিল। হেক্টরপ্রতি গড়ে ৪২ টন হিসাবে তখন পাওয়া গেছে প্রায় ১৬ লাখ টন তরমুজ। লাভের অঙ্কে হাসি ফুটেছিল কৃষকের মুখে। গতবারের লাভে এবার আরও বেশি উজ্জীবিত হয় কৃষক।
বরিশালের ৬ জেলায়ই ৬৪ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়। কৃষি বিভাগের হিসাবে উৎপাদনের আশা ছিল ২৭ লাখ টন। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উলটো। বৃষ্টির খেয়ালি আচরণে কপাল পুড়েছে কৃষকের। যখন দরকার ছিল তখন বৃষ্টি হয়নি। এখন আবার সেই বৃষ্টিতেই নষ্ট হচ্ছে খেত।
কথা হয় পটুয়াখালীর বাউফলের তরমুজ চাষি শফিক মুন্সির সঙ্গে। তিনি বাউফলের কালাইয়া এলাকায় ৩১ একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। খরচ হয়েছে প্রায় ৩২ লাখ টাকা। আশা ছিল কম করে হলেও মিলবে ৫০ হাজার পিস। অথচ মিলেছে হাজার বিশেক।
শফিক মুন্সি বলেন, গত বছর ৩০ একর জমিতে তরমুজ করেছিলাম। খরচ হয়েছিল ২৩ লাখ টাকা। বাজারে বেচে পেয়েছিলাম ৫৪ লাখের বেশি। লাভ ৩১ লাখ। লাভের আশায় এবারও তরমুজ করে এখন পথে বসার দশা। সব সময় পৌষ থেকে ফাল্গুনের মধ্যে কিছু বৃষ্টি হয় দক্ষিণে। বৃষ্টির পানিতে বাড়ে তরমুজের ফলন। এবার এই ৩ মাসে কোনো বৃষ্টি হয়নি। ফলে বাড়েনি ফলন। স্বাভাবিক সময়ের অর্ধেক ফলনও পাইনি এবার। অথচ এ বছর তরমুজ চাষে খরচ বেড়েছে প্রায় ৮ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে এবার ১৫-১৬ লাখ টাকা হবে লোকসান।
শফিক মুন্সির লোকসানের হিসাবটাই একটু ভিন্নভাবে আঘাত হেনেছে বরগুনার চাষিদের ওপর। অনাবৃষ্টি নয়, অতিবৃষ্টির কবলে পড়েছেন তারা। ৪ দিনের বৃষ্টিতে খেতে জমেছে এক থেকে দেড় ফুট পানি। ফলে পচে যাচ্ছে তরমুজের বোঁটা। ক্ষেতেই পচছে ফলন।
বরগুনায় এবার মোট ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। জেলা কৃষি বিভাগ দিয়েছে এই তথ্য। প্রায় ৪ লাখ টন তরমুজ উৎপাদনের টার্গেট থাকলেও হচ্ছে না তা। সব নষ্ট হচ্ছে বৃষ্টির কারণে।
দেড় একরের বেশি জমিতে তরমুজ করেছিলেন বরগুনা সদর উপজেলার পশ্চিম নিমতলী গ্রামের চাষি আউয়াল হাওলাদার। তিনি বলেন, সবেমাত্র লতায় আসতে শুরু করেছিল তরমুজ। ২-১টির আকার এক-দেড় কেজি হয়েছে। এরই মধ্যে বৃষ্টি ভাসিয়ে নিল সব। জমি থেকে পানি সরানোর চেষ্টা করছি। তবে তা সফল হচ্ছে না। আশপাশের খেতগুলোতেও পানি জমে আছে। এরই মধ্যে ভিজে নরম হয়ে গেছে তরমুজের বোঁটা। পানি না সরলে পচে যাবে পুরো খেতের তরমুজ।
৪ একর জমিতে তরমুজ করেছিলেন আমতলী উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের মনিরুল ও কুকুয়া ইউনিয়নের জয়নুল সরদার। তাদের জমিতেও এখন বৃষ্টির পানি। তারা বলেন, ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকায় তরমুজের চাষ করেছিলাম। এখন যা পরিস্থিতি তাতে এক টাকাও ঘরে আসবে না। পথে নামতে হবে আমাদের।
আমতলী গ্রামের বাসিন্দা রেজাউল করিম বলেন, আগে ফলনের শুরুতেই মাঠে আসত আড়ত মালিকরা। দিয়ে যেত মাঠসুদ্ধ তরমুজের অগ্রিম বায়না। বৃষ্টির পর কেউ আর যোগাযোগ করছে না। অল্প কিছু তরমুজ যা আগেই তুলে রেখেছিলাম তাও বেচতে পারছি না।’
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বরিশালের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, মূলত দুই ভাগে তরমুজের চাষ হয় দক্ষিণের বিভিন্ন জেলায়। অগ্রবর্তী চাষের তরমুজ এরই মধ্যে এসেছে বাজারে। মাঠে আছে দ্বিতীয় ধাপের তরমুজ। বরগুনা-পিরোজপুর এলাকায় হয় এই দ্বিতীয় ধাপের চাষ। পটুয়াখালী-ভোলা ও বরিশালে চাষ হয় প্রথম ধাপে। অনাবৃষ্টি আর অকাল বৃষ্টির কারণে তরমুজের ফলনে বিঘ্ন ঘটার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ৪ দিনের বৃষ্টিতে খুব একটা ক্ষতি হওয়ার কথা নয়, যদি জমিতে পানি না জমে। পানি নেমে গেলে বা যাওয়ার ব্যবস্থা থাকলে এতে আরও উপকার। জমে থাকলে গোড়া পচে নষ্ট হবে তরমুজ। এবার প্রথম ধাপেও অনাবৃষ্টির কারণে ফলন কম হয়েছে।
আবহাওয়া বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্যেও মিলেছে চলতি রবি মৌসুমে বৃষ্টির খেয়ালি আচরণের প্রমাণ। গত বছরের জানুয়ারি মাসে এই অঞ্চলে ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। পরের মাস অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে বৃষ্টি হয়েছে ৩৭ মিলিমিটার। এর বিপরীতে এ বছরের জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারিতে এক ফোঁটাও বৃষ্টি হয়নি। মার্চে এখন পর্যন্ত যে ৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে তার পুরোটাই শেষের দিকে।
বরিশাল আবহাওয়া দপ্তরের জ্যেষ্ঠ উচ্চ পর্যবেক্ষক মাসুদ রানা রুবেল বলেন, বৃষ্টির এই খেয়ালি আচরণ আগে আর কখনো হয়নি। সম্ভবত এটা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এ রকমটা চলতে থাকলে কৃষি মৌসুমের চরিত্রেও পরিবর্তন ঘটবে। যেটা হবে কৃষি সেক্টরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক শওকত ওসমান বলেন, আবহাওয়ার ওপর তো আসলে কারও হাত নেই। তবে আমরা ক্ষতি কমানোর চেষ্টা করছি। যেসব তরমুজের খেতে পানি জমেছে তা অপসারণের কাজ চলছে। তাছাড়া ক্ষতির পুরো চিত্রটি এখনো আমাদের হাতে আসেনি। মাঠকর্মীরা কাজ করছে। পুরো তথ্য হাতে এলে বোঝা যাবে কতটা ক্ষতি হয়েছে। যুগান্তর